হারিয়ে যাওয়া রামাবতী নগরী: কিছু কথা

কৈবর্ত বিদ্রোহ - দোদুল্যমান পাল সাম্রাজ্যের উপর সবচেয়ে বড় আঘাত, যা পালরাজদের বিতাড়িত করে বরেন্দ্র থেকে। দিব্ব্যোক - রুদোক - ভীম বরেন্দ্রকে পালদের হস্তচ্যুত করে রাখে ১১/১২ বছর। অবশেষে পালদের ভাগ্যলক্ষ্মী ফিরলো রামপাল ও তাঁর আঠারো রথীমহারথীর হাত ধরেই। ফলশ্রুতিতে ভীম পরাস্ত ও নিহত এবং বরেন্দ্র পালদের করায়ত্ত। সেই সাথে পাল সাম্রাজ্য নিভতে বসা প্রদীপের মত শেষবার জ্বলে উঠলো উজ্জ্বলভাবে। রামপাল বরেন্দ্র পুনরুদ্ধার করে মনোযোগ দিলেন শাসন সুসংহত করতে আর জনগণের মন জয় করতে। স্থাপন করলেন নতুন রাজধানী রামাবতী এবং গৌরববর্ধন করলেন জগদ্দল মহাবিহারের। মনে প্রশ্ন জাগে, বরেন্দ্রের প্রতি রামপালের এই টান ও ভালোবাসা কি কেবলই পিতৃভূমি বলে? নাকি রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক কারণও বিদ্যমান? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বিতীয় কারণটাই মুখ্য ও প্রথমটি গৌণ। 

(জগদ্দল মহাবিহারের মূল ঢিবির পাশের অনাবিষ্কৃত ঢিবি)

বরেন্দ্র তো স্বর্ণপ্রসবিনী - শস্য সম্পদের প্রাচুর্য তো সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই। আবার কামরূপ তো বরেন্দ্র থেকে হাতের নাগালে - এটাও কিন্তু উপেক্ষণীয় নয়। মহীপাল ও অন্যান্য পাল রাজারা বারংবার কামরূপ জয় করেছেন বলেই জানা যায়।


খোদ রামপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর "রামচরিত" গ্রন্থে বরেন্দ্রকে অভিহিত করেছেন 'বসুধা শিরোমণি' হিসেবে। সন্ধ্যাকর নিজেও অবশ্য পুণ্ড্রনিবাসী। 

বসুধাশিরোবরেন্দ্রীমন্ডলচূড়ামণিঃ কুলস্থানং।
শ্রীপৌণ্ড্রবর্দ্ধনপুরপ্রতিবদ্ধঃ পূণ্যভুঃ বৃহদ্বটুঃ।।

( রামচরিত, কবিপ্রশস্তি, ১)


যাই হোক, আমরা একটু আলোকপাত করি প্রথমে রামাবতীর দিকে। পুরনো বইপুস্তক - বিশেষ করে সন্ধ্যাকর নন্দীর "রামচরিত", রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের "বাঙ্গালার ইতিহাস", নীহাররঞ্জন রায়ের "বাঙ্গালির ইতিহাস (আদি পর্ব), আবুল ফজলের "আইন-ই-আকবরী" এবং মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বিভিন্ন লেখায় খুঁজতে শুরু করলাম রামাবতীকে। সেই কবেই হারিয়ে গেছে রামাবতী, কিছু চিহ্নবিশেষ রয়ে গেছে হয়ত - খুঁজে দেখতে চলে গেলাম নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার আমইর গ্রামে। কারণ, বিভিন্ন ইতিহাসবিদগণ রামাবতী হিসেবে আমইর গ্রামকে নির্দেশ করেন, বিশেষ করে সেখানে জগদ্দল মহাবিহার খুঁজে পাওয়ার পর থেকে। কিন্তু স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে খুঁজতে গেলে তাঁরা দেখিয়ে দিল জগৎনগরের প্রত্নস্থল। জগৎনগরের ঢিবিগুলির একটি তো জগদ্দল মহাবিহার! রামাবতী হারিয়ে গেলেও সৌভাগ্য যে, জগদ্দল হারিয়ে যায়নি; তাই আরো নতুন করে দেখলাম জগদ্দলকে। এই বিহার থেকে আধ মাইল দূরে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা উঁচু পাড়যুক্ত সুবিশাল দিঘী সহজেই নজর কাড়ে। এ যে পালরাজাদের কীর্তি তাতে সন্দেহ নেই; কারণ উত্তর-দক্ষিণ লম্বা সমস্ত দিঘীই মুসলিম-পূর্ব যুগের এবং অধিকাংশই পাল আমলের। এমন ছোটখাটো আরো জলাশয় রয়েছে এলাকাটিতে। আর জগদ্দলের আশেপাশে আরো অন্তত ১১ টি জঙ্গলাকীর্ণ উঁচু ঢিবি রয়েছে, যেগুলো খনন করা হয়নি। এছাড়াও অসংখ্য প্রাচীন নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমস্ত অঞ্চলে, মাটিতে মিশে আছে ইট ও খোলামকুচি। এসবই লুকিয়ে থাকা বা হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন নগরীর ইঙ্গিত বহন করে। এমনটাই দেখা গিয়েছে অন্য সব প্রাচীন নগরীর ক্ষেত্রে - মহাস্থান, মাহী সন্তোষ, বাণগড় ইত্যাদিতে। নিঃসন্দেহে এই এলাকায় কোন বৃহৎ নগরীর ধ্বংসাবশেষ লুকিয়ে আছে এসব ঢিবিতে।

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ঢাকার রামপালের সাথে নামের সাদৃশ্য দেখে মনে করেছেন যে রামপালই রামাবতী। কিন্তু গোল বাধলো রামচরিত পড়ে – সন্ধ্যাকর নন্দী তো বন্দনা ও প্রশংসা করেছেন করতোয়া ও গঙ্গা বিধৌত পূণ্যভূমির, যেখানে রামপাল অমরাবতীর মতো রাজধানী রামাবতী স্থাপন করেছেন।

১. অপ্যভিতো গঙ্গাকরতোয়ানর্ঘপ্রবাহপূণ্যতমাম্।
অপুনর্ভবাহ্নয়মহাতীর্থবিকলুষোজ্বলামতন্তঃ।

(রামচরিত, ৩/১০)

২. অমরাবতীসমানানেকবরেন্দ্রীকৃতাতঙ্কাম্।
সুমনোভিরভিব্যাপ্তাং নিষ্প্রতূহামৃতেন পরিপূর্ণৈঃ।

(রামচরিত, ৩/২৯)


সন্ধ্যাকর নন্দী আরো লিখেছেন, অমরাবতীর মতই এ নগরে বিদ্বান ও পূণ্যাত্মারা বাস করেন এবং কোন মিথ্যা ও ছলনার কলুষ সেখানে নেই। যদি গঙ্গা ও করতোয়ার মধ্যবর্তী পূণ্যভূমিতে রামাবতীর অবস্থান, তাহলে তো রামপালে রামাবতী থাকতেই পারে না, বরং এটি বরেন্দ্রভূমিতেই। আবার, জগদ্দলের পাশেই রয়েছে মরা নদীর খাত, যে নদীকে লোকজন ডাকে কোতরা নদী বলে। কোতরা করতোয়ার বিকৃত নাম হওয়া আশ্চর্যের নয়, এটি করতোয়ার কোন শাখা হওয়া সম্ভব। সেদিক থেকেও, রামাবতী এই বরেন্দ্র অঞ্চলেই, ঢাকায় নয়।


আবার নগেন্দ্রনাথ বসু বগুড়া জেলায় মহাস্থানগড়ের সন্নিকটস্থ রামপুরা নামক স্থানকে রামাবতী বলে মত দিয়েছেন। সেটাও সম্ভব নয়। কারণ, আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতেও রামাবতীর নাম পাওয়া যায়। খুব সম্ভব, রামাবতী সমস্ত যৌলুস হারিয়ে কেবল নামে টিকে ছিলো। স্বভাবতই 'রামাবতী' শব্দটি ফারসি উচ্চারণে রমৌতী হয়ে গিয়েছে, যেমন লক্ষ্মণাবতী হয়েছে লক্ষ্মণৌ। আইন-ই-আকবরী অনুযায়ী, রমৌতী সরকার জিন্নাতাবাদে অবস্থিত। সে হিসাবে সমস্ত ধামইরহাট অঞ্চল সরকার জিন্নাতাবাদের অন্তর্ভুক্ত। অপরদিকে বগুড়া অঞ্চল সরকার ঘোড়াঘাট এবং রামপাল ও সমস্ত ঢাকা সরকার সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত। সুতরাং রামাবতী ধামইরহাটে অবস্থিত জগদ্দল বিহারের পাশেই, আজকের আমইরে সে বিষয়ে মোটামুটি নিঃসন্দেহ। বরেন্দ্র অঞ্চলে 'র' বর্ণের উচ্চারণ 'অ' হয়ে যায়; আর ফারসি প্রভাবে রমৌতীও বিকৃত হওয়া সম্ভব। ফলে একসময় রামাবতী কালক্রমে হয়ে গিয়েছে 'আমইর'।


রামাবতীর রূপ সৌকর্য নিয়ে চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায় রামচরিতে। সর্বদা দান-ধ্যানে পরিপূর্ণ থাকতো রামাবতী। রামপাল সমস্ত জীবন কাটিয়েছেন রামাবতীতে এবং পরবর্তী সকল পাল রাজাদের রাজধানী, অর্থাৎ পাল আমলের সর্বশেষ রাজধানী ছিলো রামাবতী। রামপালের পুত্র মদন পালদেবের তাম্রশাসন মনহলি লিপিতে এর সমর্থন পাওয়া যায়,"রামাবতীনগর পরিসরসমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবার"।


নীহাররঞ্জন রায়ের "বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব) এ রামাবতীর বর্ণনা এরূপ:


রামাবতী নগর প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন তৃতীয় বিগ্রহপালের পুত্র রামপাল; মদনপালের মনহলি লিপি এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে এই নগরের উল্লেখ ও বর্ণনা আছে। রামাবতী এবং আইন-ই-আকবরী কথিত রামাউতি যে এক এবং অভিন্ন নগর, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের এতটুকু অবকাশ নাই। পরবর্তী সেন-আমলের গৌড় বা লক্ষ্মণাবতী নগরের অদূরে গঙ্গা-মহানন্দার সঙ্গমস্থলের সন্নিকটে ছিল রামাবতীর অবস্থিতি। আজ রামাবতীর পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষ লক্ষ্মণাবতীর প্রাচীন কীর্তিহর্ম্যাদির অদূরে মাটির ধূলায় মিশিয়া গিয়াছে। অথচ সন্ধ্যাকারের বর্ণনা হইতে মনে হয়, সমসাময়িককালে রামাবতী সমৃদ্ধ নগর ছিল।


পাল আমলে জয়স্কন্ধাবারগুলির সামরিক গুরুত্ব লক্ষণীয়; অনুমান হয়, এই সামরিক গুরুত্ব বিবেচনা করিয়াই জয়স্কন্ধাবারগুলি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। পাটলীপুত্র, মুদ্গগিরি, বিলাসপুর, হরধাম, রামাবতী এবং বোধহয় বটপর্বতিকাও, প্রত্যেকটিই গঙ্গার তীরে তীরে। এই গঙ্গা বাহিয়া রাজমহলের তেলিগাঢ়ি ও সিক্রিগলির সংকীর্ণ গিরিবর্ত্মের ভিতর দিয়াই বাঙলায় প্রবেশের পথ, পাল-রাজ্যের হৃদয়স্থলে প্রবেশের পথ এবং পাটলীপুত্ৰ হইতে আরম্ভ করিয়া রামাবতী পর্যন্ত সমস্ত পথটিই সুরক্ষিত রাখা প্রয়োজন ছিল। পাল-রাষ্ট্র তাহাই করিয়াছিল।


সুতরাং এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। আমইরে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা ও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে একদিন অবশ্যই প্রমাণিত হবে আমইর এ রামাবতীর অবস্থান। অপেক্ষায় থাকলাম....


তথ্যসূত্র:

১. রামচরিত, সন্ধ্যাকর নন্দী

২. বাঙ্গালার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়

৩. বাঙ্গালির ইতিহাস (আদি পর্ব), নীহাররঞ্জন রায়

৪. আইন-ই-আকবরী, আবুল ফজল

৫. মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর রচনাসমগ্র (১-৫ খন্ড)

Comments

  1. আমইরে রামাবতি - গুড নিউজ!

    ReplyDelete
  2. আমইরে রামাবতি - গুড নিউজ!

    ReplyDelete
    Replies
    1. অবশ্যই ভালো লাগার মতো কথা

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)