জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

রূপকথা – লোকগাথা – পুণ্ড্রনগর এ তিনটি বিষয় যেনো অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। পুণ্ড্রনগরের সুবিশাল প্রত্নভান্ডারের প্রতিটি নিদর্শনের সাথেই জড়িয়ে আছে কোন না কোন রূপকথা নয়ত লোকগাথা। আপনি পুণ্ড্রনগরে গিয়েছেন, অথচ 'জিয়ৎ কুণ্ড' দেখেননি, এটি অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার বটে।

'জিয়ৎ কুণ্ড'কে জিইয়ে রেখেছে এর সাথে জড়িত লোকগাথাটি। সমগ্র পুণ্ড্র-বরেন্দ্রবাসীর মুখে মুখে গল্পটি আজো বয়ে চলেছে নিরবধি। গল্পটি শুনুন তাহলে।

সময়টা ৯৬৫ শকাব্দ (১০৪৩ খ্রীষ্টাব্দ) মতান্তরে ১২৬৫ শকাব্দ (১৩৪৩ খ্রীষ্টাব্দ)। পুণ্ড্রের সুদৃঢ় দূর্গপ্রাচীরের ওপারে শত্রুসৈন্য দাঁড়িয়ে যুদ্ধ ভেরী বাজাচ্ছে। এ-তো আর প্রথম ঘটছে না, পুণ্ড্রের ওপর বর্হিশত্রুর শ্যেনদৃষ্টি যুগ যুগ ধরে রয়েছে। পুণ্ড্রের রাজা পরশুরামও প্রস্তুত শত্রুদের উদ্ধত হাত ভেঙে ফেলতে। তবে এবারের যুদ্ধটি একটু ভিন্ন, শত্রুদের অধিনায়ক একজন আধ্যাত্নিক মানুষ, লোকে বলে যবন সাধু। ইনি হলেন শাহ সুলতান বলখী (রঃ), বাংলায় আগত প্রথম পীর। তাঁর দলে ইতোমধ্যে যোগ দিয়েছেন রাজা পরশুরামের বহুদিনের বিশ্বস্ত হরিহর পাল ও আরো দুজন দ্বাররক্ষী। এরা পরশুরামের সুলুকসন্ধান কিছুটা জানে।

যুদ্ধ শুরু হলো। দুপক্ষের সেনা সমানে হতাহত হচ্ছে। চারদিকে মার-মার রব। পরশুরামের সৈন্য যারা শত্রু আঘাতে ভূপতিত, অন্যরা তাদের টেনে হিঁচড়ে দূর্গের ভেতর নিয়ে যাচ্ছে। কিছু সময় অতিবাহিত হলে শাহ সুলতান লক্ষ্য করলেন, পরশুরামের সৈন্য যেনো।কমছেই না। হরিহর পালের তলব পড়ল সুলুকসন্ধানের জন্য। শাহ সুলতান জানতে পারলেন গোপন রহস্যটি, পরশুরামের অজেয় থাকার কারণটি। পুণ্ড্রের দূর্গের ভেতরে রয়েছে এক আশ্চর্য কূপ, জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড তার নাম। মৃতকে প্রাণদায়ী জল সে কূপের। মৃত সৈন্যদের ওপর সে কূপের জল ছিটিয়ে দিলেই সে আবার জীবিত হয়ে যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে।



ভাবতে লাগলেন শাহ সুলতান। সহসাই সমাধান একটা পাওয়া গেলো। নিজের পোষা চিলের ঠোঁটে এক টুকরো গোমাংস দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন কাজ। চিল গোমাংস টুকরো নিয়ে উড়ে চললো দূর্গের দিকে। জিয়ৎ কূপের উপর দিয়ে উড়ে যাবার সময় মাংসের টুকরো ফেলে দিল চিল। টুকরোটি জিয়ৎ কূপে পড়ামাত্র সমস্ত অলৌকিক শক্তি হারিয়ে ফেললো। পরাজিত হলেন রাজা পরশুরাম অবশেষে। অজেয় পুণ্ড্র পদানত হলো মুসলমানদের। 

নিছকই লোকগাথা নাকি ইতিহাসের উপাদান লুকিয়ে আছে গল্পটিতে? বিজ্ঞানমনস্ক অনেকে সবটাই হেসে উড়িয়ে দেবেন। আমি বিজ্ঞান মানলেও সবটা বাতিল করছি না। কারণটি একটু পরে বলছি। তার আগে বলি জিয়ৎ কূপের কথা।

পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়) এর অন্যতম একটি প্রত্নস্থল জিয়ৎ কূপ বা জিয়ন কূপ বা অমর কুণ্ড। দূর্গ প্রাচীরের অভ্যন্তরে পরশুরামের প্রাসাদের অদূরেই এই প্রাচীন কূপটি। উপরের দিকে ৩.৮৬ মিটার ব্যসবিশিষ্ট কূপটি ক্রমশ নিচের দিকে ছোট হয়ে গিয়েছে। কূপের গায়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে কিছুটা অংশ বাহিরে রেখে পাথরখণ্ড গাঁথা আছে। সম্ভবত কূপ থেকে পানি ওঠানোর সুবিধার জন্য এমনটা করা হয়েছে। পাথরখণ্ডগুলি নিশ্চিতভাবে অন্য কোন প্রাচীন স্থাপনা থেকে সংগৃহীত। সবচেয়ে বড় পাথরখণ্ডটিতে এখনও ফুল-পাতা নকশা ক্ষীণভাবে বুঝা যায়। সময়ের সাথে সাথে কূপটি অনেকটা বুজে গিয়েছে, তলদেশ একদম শুকনো। 

কে কবে কূপটি খনন করেছে তা জানা যায়নি। কূপে ব্যবহৃত ইটের ধরণ দেখে এটি ১৮ শতক থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়কালের ধরা হয়। তবে পুরনো কূপ সংস্কার করার সময় হাল আমলের ইট ব্যবহার করা খুবই স্বাভাবিক। যদি কূপটি রাজা পরশুরামের সময়কালের ধরা হয়, সে হিসেবে এটি ১৩শ থেকে ১৪শ শতকের হওয়ার কথা। নগরবাসীর জলকষ্ট দূর করার জন্য কূপটি খনন করা হয়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ মত দিয়েছেন। 



এখন আসি লোকগাথার বিষয়ে। পরশুরামের সাথে শাহ সুলতানের যুদ্ধের বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে, অন্তত সময়কাল নিয়ে এবং শাহ সুলতান বলখী একজন ব্যক্তি না একাধিক এ নিয়ে সন্দেহ খুব প্রবল, যদিও এ বিষয়ে গবেষণা করার স্পৃহা অজানা কারণে গবেষকদের মাঝে খুব কম। শাহ সুলতান বলখী মাজার নিয়ে আলাদা লেখায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে আছে। 

লোকগাথাটি খেয়াল করলে একটা বিষয় মাথায় আসে, সেটা হলো মুসলমান সৈন্যদের পুণ্ড্র দখলের জন্য পুণ্ড্রনগরী অবরোধ। যুদ্ধটি রাজা পরশুরামের সাথে যার-ই হোক না কেন, তারা যে দূর্গ নগরীটি অবরোধ করেছিল সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং অবরোধকালে ভেতরের মানুষদের পানির উৎস দখল বা বিনষ্ট করে আত্মসমর্পণের চাপ দেওয়া একটি যুদ্ধকৌশল হিসেবে বহুল পরিচিত। সে হিসেবে জিয়ৎ কূপের মৃত সঞ্জীবনী শক্তি না থাকলেও পিপাসা মেটানোর ক্ষমতা ছিলো। তাই কূপটি দখল বা বিনষ্ট হওয়া পুণ্ড্রনগর মুসলমানদের করতলগত হওয়ার একটি কারণ হতে পারে। আবার,  পুণ্ড্রে তন্ত্রের প্রভাব খুবই সুস্পষ্ট। পরশুরামের বোন, মতান্তরে কন্যা শীলাদেবী তন্ত্রসিদ্ধ বলে প্রসিদ্ধা। তন্ত্রে অধিকারের কারণে শীলাদেবী পূজ্য দেবীর স্থান পেয়েছেন পুণ্ড্রে এবং এঁকে কালীর অংশ বলে মনে করা হয়। সুতরাং কূপটি যে তন্ত্রসিদ্ধ জলের কিনা সেটা ভাববার বিষয়। তাই লোকগাথার আড়ালে এসব সত্যটি নিহিত হয়ে রয়েছে বলে মনে করি। সর্বশেষ, খেয়াল করলে দেখবেন, পুণ্ড্রে মুসলমান আগমনের পেছনেও খলনায়কের ভূমিকায় পাল পদবীধারী হরিহর পাল। এ যেনো বৌদ্ধদের মুসলমানদেরকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রতিচ্ছবি। ঘরের শত্রু বিভীষণ। 

যাই হোক, জিয়ৎ কুণ্ড নিয়ে একটি কুসংস্কার প্রচলিত ছিলো কিছুদিন আগেও। দর্শনার্থীরা কেউ কেউ ৫/১০ টাকা কূপে ফেলে মনের আশা জানাতো। এতে নাকি মনস্কামনা পূর্ণ হয়। এখন অবশ্য এসব ধারণা বদলে গিয়েছে। 



পুরাণে বর্ণিত আছে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য একবার শিবের কাছ থেকে মৃত সঞ্জীবনী মন্ত্র লাভ করেন। কিন্তু বেশিদিন সেটি রাখতে পারেন নি বিষ্ণুর কৌশলে। আসলে মৃতকে জীবন দেওয়ার চেষ্টা মানুষের অনাদিকাল থেকেই। তবে প্রকৃতির ইচ্ছা এটা না হতে দেওয়া। তাই তো শুক্রাচার্যই হোক, আর পুণ্ড্রের জিয়ৎ কূপ হোক, সে ক্ষমতা কেউই রাখতে পারে নি। 

তবে এগুলো সবই রূপকথা – লোকগাথায় মানায়, বিজ্ঞানমনস্করা তো মুচকি হেসে উড়িয়ে দেবেন। আমার একটা বিরাট সুবিধা রয়েছে। আমি ইতিহাসবিদ নই, প্রত্নতাত্ত্বিক নই, বিজ্ঞানী তো নই-ই। তাই জিয়ৎ কূপ দেখে ও লোকগাথা শুনে অনায়াসে সেসব লিখতে পারছি বিনা দ্বিধায় – জানি এসব লেখা কারো পাতে দেয়া যাবে না, তাই সমালোচনার ভয় নেই। সাধারণ নাগরিক হওয়ার এ এক মস্ত সুবিধা। 

তথ্যঋণ:

১. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান 

২. মহাস্থানগড় এলাকায় প্রচলিত লোকগাথা 

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)