পাথরঘাটা: পঞ্চনগরীর সন্ধানে (২য় পর্ব)
|| পাথরঘাটা: পঞ্চনগরীর সন্ধানে (২য় পর্ব) ||
গত ২৩ অক্টোবরে আরেকবার ঘুরে আসলাম পাথরঘাটা। এবারের লক্ষ্য ছিলো পাথরঘাটার অন্যান্য ঢিবিগুলো ঘুরে দেখা ও তথ্য সংগ্রহ করা। অনেক কিছু নতুন করে দেখলাম ও উপলব্ধি করলাম। তবে সেকথা আরেকটি পর্বে হবে। আজকে বিশেষ করে লিখবো মানুষের লোভের থাবায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া একটি ঢিবির কথা, যেটি ছিলো পাথরঘাটা তথা পঞ্চনগরীর গুরুত্বপূর্ণ একটি ধ্বংসাবশেষ।
ঢিবিটির নাম কাসিয়াবাড়ি ধাপ। এই ঢিবি সম্পর্কে জানতে পেরেছিলাম দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র থেকে। সূত্রদুটি নিচে উদ্ধৃত করছি:
১. Among other sites, the undisturbed Kasia-bari mound, about three furlongs to the north-east of the main site, is the most important. Roughly circular in shape, about 250 feet across and 20 to 25 feet high, it has another interest: on its top under a large banyan tree lie a number of large black stone images and fragments. The department could not collect them as they are said to be worshiped by local Hindus. Among the pieces, a large, life-size Visnu image of about 12th–13th century A.D., a fine bust of a god, a medium-sized Siva linga and Gauri-patta and a few heads are interesting. The finest pieces are reported to be stolen recently, while many were damaged by a mad Faqir. One large image has been removed to the temple of a nearby village. (Bangladesh Archaeology, 1979, page 13)
২. তুলসীগঙ্গা নদীর পূর্বতীরে প্রায় আধ মাইল দূরে কাসিয়াবাড়ি ধাপটি পাথরঘাটার ধ্বংসাবশেষ এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা দর্শনীয় মোটামুটি গোলাকার এবং প্রায় ২৫০ ফুট প্রশস্ত ও ২৫ ফুট উঁচু এই ঢিবিটি সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই ঢিবিটি এখন পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় আছে। এর উপরে নানাস্থানে বিক্ষিপ্ত মৃৎপাত্রের টুকরো ও ইট ছাড়াও স্থানে স্থানে সুবিন্যস্ত ইটের গাঁথুনি দৃষ্টিগোচর হয়। এই ধাপের কেন্দ্রস্থলে কয়েকটি চমৎকার প্রাচীন মূর্তি অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে। স্থানীয় হিন্দু অধিবাসীরা এখানে পূজা-অর্চনা করে থাকে। মূর্তিগুলোর মধ্যে কালো পাথরের ৪ ফুটের অধিক উঁচু একটি বিষ্ণুমূর্তি ও ক্ষতিগ্রস্থ আর একটি দেবমূর্তি উল্লেখযোগ্য। এগুলোকে সেনযুগের (দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের) ভাস্কর্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলে গণ্য করা যায়। (প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান, পৃষ্ঠা ৮১)
উদ্ধৃতি দুটি থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত যে, কাসিয়াবাড়ি ধাপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। পাথরঘাটার প্রাচীন পাথরের সেতুর অপর পাড়ে বস্তুত এর অবস্থান। এবার আসি নিজের চোখে দেখা কষ্টদায়ক বাস্তবতায়।
যখন কাসিয়াবাড়ি ধাপে পৌঁছলাম, বেলা তখন দুপুর ২ টা। ধারণা ছিলো একটা উঁচু ঢিবি দেখতে পাবো। কিন্তু কোথাও তেমন কিছু নজরে পড়লো না। নেই কোনো সরকারী সাইনবোর্ড। আমি দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছি এমন সময় এক সাইকেল আরোহী এগিয়ে এলেন এবং জানতে চাইলেন কাউকে খুঁজছি কিনা। যখন জানতে চাইলাম কাসিয়াবাড়ি ধাপ কোথায়, তখন তার উত্তরে থতমত খেয়ে গেলাম। যেখানটায় দাঁড়িয়ে আছি, সেটাই নাকি সেই ঢিবি। তাকে অনুরোধ করাতে তিনি জানালেন, ১০/১২ বছর আগে তিনি এবং আরো ২০/২৫ টি পরিবার কাসিয়াবাড়ি ধাপটি নিজেদের নামে পত্তন করিয়ে নিয়েছে স্থানীয় ভূমি অফিস থেকে। তারপর তারা ধাপটি সম্পূর্ণ ভেঙে বসতবাড়ি তৈরী করে। এখন সেখানে প্রায় ২৫ ঘর হিন্দু পরিবার বাস করে। ভদ্রলোক জানালেন, গত কয়েকবছর আগে নতুন ঘর তৈরীর জন্য মাটি খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে লম্বা ভিত্তি প্রাচীর ও সিঁড়ি; যেগুলো তারা ভেঙে ফেলেন তখন।
সাইকেল আরোহীর সাথে কথা হচ্ছিল একটি ইটের তৈরী সন্ন্যাস মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে। পুরনো মুর্তির কথা জানতে চাইলে জানালেন এই সন্ন্যাস মন্দিরের সামনেই ছিলো অনেকগুলো পাথরের মূর্তি ও শিবলিঙ্গ। তারা সবাই পূজা করতেন। রাতের অন্ধকারে কে বা কারা সবগুলো মূর্তিই একে একে নিয়ে গেছে। বর্তমানের সন্ন্যাস মন্দিরটি স্থানীয় একজন ঠিকাদার পাশের রাস্তা নির্মাণের সময় তৈরী করে দিয়েছে, যেখানে সন্ন্যাসের মাটির মূর্তি পূজিত হচ্ছে। মন্দিরের সামনেই কয়েকটি ছোট ছেলেমেয়ে কড়ি খেলছে দেখলাম, কড়িগুলো সবই পুরনো ইটের টুকরো।
ভদ্রলোকটি আমাকে জলদি বিদায় নেবার ইঙ্গিত করছেন বুঝতে পারলাম, হয়তো আমাকে সাংবাদিক মনে করে আর পাছে তাদের শান্তিময় দিনযাপনে কোনো ঝামেলা বয়ে আনি সেই আশঙ্কায়। আবার হতেও পারে জমি বরাদ্দ নিয়ে আমার দ্বারা কোনো ঝামেলা হতে পারে ভেবেছেন।
যাই হোক, শূন্য হাতে ফিরতে যাবো এমন সময় নজরে পড়লো গাছের শেকড়ের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে প্রাচীন ইটের গাঁথুনি। যেনো ইশারায় জানিয়ে দিলো তাদের টিকে থাকার শেষ চেষ্টাকে। হয়ত বললো, ওহে আমি এখনো আছি!
কি জানি, হয়তো তাই।
চটপট দুটি ছবি তুলে বিদায় নিলাম, কারণ ভদ্রলোক সাইকেল নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তখনো তাকিয়ে আমার দিকে। আর হয়তো যাবো না ওই ধ্বংসস্তূপ দেখতে। সুখে থাক মানুষের লোভ আর অন্যায়।
Comments
Post a Comment