বেল আমলা ও বারো শিবালয়ের প্রত্নস্থল, জয়পুরহাট

বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলার রেলস্টেশন থেকে ৪/৫ কিঃমিঃ দূরের একটি গ্রাম বেলআমলা। শান্ত নিরিবিলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট যমুনা নদী। নিভৃত গ্রামটি কিন্তু ইতিহাস ও প্রত্নসম্পদেও সমৃদ্ধ।

বেলআমলার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এখানকার প্রাচীন শিবমন্দিরগুলো। গ্রামটির তিনটি আলাদা স্থানে যথাক্রমে এক শিবালয় (এক মন্দির), পাঁচ শিবালয় (পাঁচটি মন্দির) এবং বারো শিবালয় (১২ টি মন্দির); মোট ১৮ টি শিবালয় বা শিবের মন্দির অবস্থিত। চমৎকার বিষয় হল মাত্র ২-২.৫ কিঃমিঃ ব্যাসার্ধের মধ্যে মন্দিরগুচ্ছগুলি রয়েছে। বাংলাদেশের অন্য কোন গ্রামে এতগুলো শিবের মন্দির একসাথে দেখা যায়না, এমনকি এই উপমহাদেশেও এমন স্থাপনা বিরল। যদিও ১৮টি মন্দির, তবুও স্থানটি বারো শিবালয় নামেই খ্যাত।



মন্দিরগুলির অষ্টাদশ শতকের শেষ বা উনিশ শতকের প্রথমদিকে স্থানীয় ধনী গন্ধবণিক রাজীব লোচন মন্ডল নির্মাণ করেন। রাজীব লোচন মুর্শিদাবাদের জগৎশেঠের মতোই অত্যন্ত সম্পদশালী ও বিত্তবান ছিলেন; এই মন্দিরগুলি তেমনই ইঙ্গিত দেয়।


(Photo Credit: www.joypurhat.gov.bd)

অপূর্ব টেরাকোটার কারুকার্য শোভিত প্রত্যেকটি মন্দির। যদিও এখন টেরাকোটার কারুকার্য সব ঢাকা পড়েছে হালআমলে স্থানীয় জনগণের করা সংস্কারকাজে এবং অবিবেচকের মতো করে করা চুনকামের নিচে। কিছু টেরাকোটা চুরিও হয়ে গেছে মন্দিরের গা থেকে। একটি মন্দিরে পাওয়া গেছে ৩৬০ টি মুর্তি খচিত একজোড়া কাঠের বিশাল দরজার কবাট, যেটা ১৯৭০ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংগৃহীত হয়েছে।



পাঁচ শিবালয়ের পুরনো মন্দিরগুলো অতিশয় জীর্ণ অবস্থায় রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। বর্তমানে নতুন আলাদা মন্দির নির্মিত হয়েছে ঐ পাঁচটি পুরনো মন্দিরের পাশে এবং প্রাচীনগুলো পরিত্যক্ত।


হাল আমলের পাঁচ শিবালয়

বারো শিবালয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট যমুনা নদীটি।

এক শিবালয়ের সাথে আছে একটি সুবিশাল দীঘি, যেটা মন্দিরের জন্যই খননকৃত বলে প্রতীয়মান হয়। একমন্দিরের কাছেই কয়েকটি উঁচু ঢিবি জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। খননের ফলে একটি চন্ডীমুর্তি, একটি সূর্যমুর্তি এবং একটি চতুষ্কোণ পাথরখন্ড পাওয়া গেছে যাতে বুদ্ধের মুর্তি উৎকীর্ণ আছে। যে ঢিবিতে চন্ডীমুর্তি পাওয়া গিয়েছে সেখানে খুব সামান্য খননের ফলে একটি চমৎকার মন্দিরের চূড়ার অংশ ও একটি কুলুঙ্গি বেরিয়ে এসেছে। মন্দিরের বাকী অংশ মাটির নীচে চাপা পড়ে আছে। চন্ডীমুর্তির নীচে "রাজ্ঞী শ্রীগীতা তারা" খোদিত আছে। সবকয়টি মুর্তি বরেন্দ্র জাদুঘরে রক্ষিত আছে। এছাড়া এই ঢিবিতে অসংখ্য পোড়ামাটির ঘোড়া ও কিছু মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।


(Photo Credit: www.joypurhat.gov.bd)


বেল আমলা প্রত্নস্থল সম্পর্কে অক্ষয়কুমার মিত্রের মতামত এরূপ:

"বগুড়া জেলার অন্তর্গত বেল আমলা নামক গ্রাম হইতে সম্প্রতি এইরূপ পরিচয় আবিষ্কৃত হইয়াছে। বগুড়ার ডেপুটী কালেক্টার চিরস্নেহাস্পদ শ্রীমান রাজেন্দ্রলাল আচাৰ্য্য বি, এ, তৎসম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের (রঙ্গপুরের) প্রথম অধিবেশন পঠিত হইবার জন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন।
বেল আমলা একটি পুরাতন গ্রাম। তথায় কতকগুলি পুরাতন দেবমন্দির বর্তমান আছে। তাহা সমধিক পুরাতন না হইলেও, অনুসন্ধানের যোগ্য বলিয়া, শ্রীমান রাজেন্দ্রলাল তথায় উপনীত হইয়া, গ্রামের মধ্যে একটি পুরাতন চতুর্ভুজা মূৰ্ত্তির সন্ধান লাভ করেন। এই মূর্তি কোনও পুরাতন মন্দির হইতে আনীত হইয়া, গ্রামের মধ্যে রক্ষিত হইয়াছিল। মূর্তিটি প্রস্তরগঠিত; তাহার পাদদেশে পুরাতন অক্ষরের একটি খোদিত লিপি বর্তমান আছে। যতদূর পাঠ করিতে পারা যায়, তাহাতে বোধ হয়–”রাজ্ঞী শ্রীগীতা তারা” লিখিত আছে। হিন্দুদিগের তারামূৰ্ত্তির সহিত এই মূৰ্ত্তির কিছুমাত্র সাদৃশ্য নাই। ইহা বৌদ্ধ তারামূৰ্ত্তি। তাহাকে কখন “অগ্নি বা তরবারি” স্পর্শ করে নাই। গ্রামের নিকটে একটি পুরাতন মন্দির ছিল বলিয়া এখনও জনশ্রুতি বর্তমান আছে। তাহার চিহ্নমাত্রও বর্তমান নাই। কবে কিরূপ ঘটনাসূত্রে সে মন্দির বিলোপ প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহারও তথ্যলাভের আশা নাই। যেখানে মন্দির ছিল, সেখানে এখনও ইষ্টকপ্রস্তরের সমাবেশ দেখিতে পাওয়া যায়। তথায় অনুসন্ধানকার্যে নিযুক্ত হইয়া, শ্রীমান রাজেন্দ্রলাল একখানি খোদিত প্রস্তর প্রাপ্ত হইয়াছেন। তাহা প্রায় সমচতুষ্কোণ;–তাহার উভয় পৃষ্ঠেই নানামূৰ্ত্তি খোদিত আছে। একপৃষ্ঠে কতকগুলি ক্ষুদ্র বৃহৎ প্রকোষ্ঠ অঙ্কিত আছে। তাহার প্রধান প্রকোষ্ঠে একটি যোগাসনে উপবিষ্ট, চতুর্ভুজ মূৰ্ত্তি; –উপরের দুই হস্তে গদাপদ্ম, নীচের দুই হস্ত জানুবিন্যস্ত,– দেখিবা মাত্র বুঝিতে পারা যায়, বুদ্ধ মূর্তির সহিত দুইটি অতিরিক্ত হস্তযোজনা করিয়া, তাহাকে শ্ৰীমন্নারায়ণ মূর্তিতে পরিবর্তিত করা হইয়াছে! শ্রীমূর্তির পদতলের প্রকোষ্ঠে যে সকল বিচিত্র কারুকার্য খোদিত ছিল, তাহারই অংশবিশেষ পরিবর্তিত করিয়া, একটি গরুড় মূর্তির আভাস প্রদান করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। কিন্তু উভয় পার্শ্বের শীর্ষদেশের প্রকোষ্ঠগুলির অন্যান্য খেদিত মূৰ্ত্তির কোনরূপ পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয় নাই। তাহাতেই এই প্রস্তর ফলকের বৌদ্ধকীৰ্ত্তি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইতে পারে নাই। শ্রীমূৰ্ত্তির শীর্ষদেশে আর একটি যোগাসনে উপবিষ্ট দ্বিভুজ মূর্তি; দুই দিক হইতে দুইটি হস্তি তাহার মস্তকে জলসেক করিতেছে। ঠিক এইরূপ একটি চিত্র সাঁচি স্কুপের পূৰ্ব্বদ্বারে সংযুক্ত আছে। সুতরাং ইহা যে বৌদ্ধ যুগের কীৰ্তিচিহ্ন, তাহাতে সংশয় নাই। তাহাকে সমন্বয়যুগে নারায়ণবিগ্রহের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষার্থ যথাসাধ্য রূপান্তরিত করা হইয়াছে। অপর পৃষ্ঠায় একটি দশদল পদ্ম;–তাহার প্রতি দলে বিষুর দশাবতারের এক একটি চিত্র খোদিত করা হইয়াছে। প্রথমে মৎস্য, তাহার পর যথাক্রমে কল্কি পর্যন্ত অন্যান্য অবতার। নৃসিংহ হিরণ্য কশিপুর উদর বিদীর্ণ করিতেছেন;-বামন ছত্ৰমস্তকে দণ্ডায়মান;-কুঠারহস্তে পরশুরাম; সংগ্রামোচিত পদবিন্যাসে রামচন্দ্র; –হলফলকধারী বলরাম; –যোগীবর বুদ্ধ; –অশ্বারোহী কল্কিদেব – সকলেই যথাযোগ্য আয়ুধাদিতে শোভা পাইতেছেন! উভয় পৃষ্ঠের শিল্পকৌশলের তুলনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, দশাবতার অঙ্কনের শিল্পকৌশল অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট; বুদ্ধমূর্তির সহিত যে দুই খানি অতিরিক্ত হস্ত সংযুক্ত হইয়াছে তাহার শিল্পকৌশলও তদ্রূপ। ইহাতে ধৰ্ম্মসমন্বয়ের সুস্পষ্ট পরিচয় অভি ব্যক্ত হইয়া রহিয়াছে। পালনরপালগণের শাসন সময়ে ধর্মসমন্বয়ে সাধিত হইবার প্রমাণ পরম্পরার অভাব নাই। তাঁহারা মহাভারত পাঠ করাইয়া ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা দান করিতেন; মহা সামন্তাধিপতির আবেদনে শ্ৰীমন্নারায়ণ বিগ্রহের স্থাপনার জন্য ভূমিদান করিতেন; এইরূপ নানা প্রমাণ তাম্রশাসনে প্রাপ্ত হওয়া যায়। ইহার সহিত ‘অগ্নি এবং তরবারির” আখ্যায়িকার সামঞ্জস্য নাই!"

(উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তি, অক্ষয়কুমার মৈত্র, প্রবাসী, কার্তিক, ১৩১৫)


উপরোক্ত আলোচনা থেকে সহজেই অনুমিত হয় প্রত্নস্থল হিসেবে বেল আমলা কতটা গুরুত্ব বহন করে। আমি ২০০৪/৫ সালে একমন্দিরে যাওয়ার পথে জঙ্গলে ঢাকা উঁচু ঢিবিটি দেখেছি অনেকবার। স্থানীয়দের নিষেধ উপেক্ষা করে জঙ্গলে ঢাকা ঢিবিটি দেখে খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম। বড় গাছের শিকড়ে ডুবে গেলেও মন্দিরের শুন্য গর্ভগৃহের তিন দিকের দেয়াল ও সামনের প্রবেশ পথের নকশাকার কাজ তখনো টিকে ছিল। পূর্বমুখী ছিল মন্দিরটি। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ছোট কুলুঙ্গি রয়েছে। নির্মাণে ব্যবহৃত প্রাচীনকালের ইটগুলো পাল আমলের। মন্দিরটির অদূরে একটা গাছের নিচে অনেক পোড়ামাটির হাতি ও ঘোড়া পড়ে ছিল। নিঃসন্দেহে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ছিল এটি। বর্তমানে ঢিবিটি আর টিকে নেই। ঢিবি কেটে কলা ও আখ চাষ করতে দেখলাম গত মাসে গিয়ে। ঢিবিটির ৫০০ মিটার দূরেই আরো প্রাচীন স্থাপনা ছিল, যেগুলো কেটে সমান করে কৃষি জমি করা হয়েছে। তবু আজো পুরনো ইটের টুকরা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। এই হেলায় হারানো প্রাচীন স্থাপনাতে গবেষণা করলে জয়পুরহাটের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে অজানা অধ্যায় জানা যেত। কি অমূল্য রত্ন আমরা হেলায় হারালাম!

২৭/০৫/২০১৭ তারিখে বেল আমলার বারো শিবালয়ে দুর্বৃত্তরা রাতের অন্ধকারে হামলা চালায়। ১২ টি শিবালয়ের ১২ টি শিবলিঙ্গ ও মন্দির প্রাঙ্গনে থাকা নন্দীর মূর্তিতে দাহ্যপদার্থ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। জয়পুরহাটের ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল। হিন্দু মুসলিম বছরের পর বছর সম্প্রীতি নিয়ে বাস করছে ছোট্ট এই জেলাতে।


(ছবিঃ দৈনিক সমকাল)

যাই হোক, একমন্দির সংলগ্ন দীঘিটি নিয়ে একটি কিংবদন্তি আছে। মন্দির নির্মাতা রাজীব লোচন স্বপ্নাদেশ পেয়ে দীঘিটি খনন করেন। কিন্তু খনন শেষ হলেও দিঘীতে কোন জলের দেখা নেই। চিন্তিত রাজীব লোচন আবারো স্বপ্নে আদেশ পেলেন যে দীঘির মাঝখানে একটি ব্রাহ্মণ শিশুকে আসনে বসিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে পূজা দিতে হবে ফুল, ঘৃত প্রদীপ, ধুপ ও সন্দেশ নৈবেদ্য দিয়ে। পূজা শেষ হলে সবাইকে দিঘী থেকে উঠে যেতে হবে শিশুটিকে রেখে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের শিশুপুত্র আনা হল এবং সকল আচার পালন করা হল। পূজা শেষে সবাই শিশুটিকে রেখে যখন পাড়ে উঠে আসলো, সঙ্গে সঙ্গে কলকলিয়ে জল বের হতে লাগলো এবং দিঘী পু্র্ণ হয়ে গেলো। ব্রাহ্মণ শিশুটি বলি হয়ে গেলো দিঘীর জলে ডুবে। এখনো দিঘীতে কাকচক্ষু জল এবং কখনো জল শুকায় না। এমনকি এই দিঘী থেকে জল সেচে পাশের জমিগুলোতে দেয়া হয় কৃষিকাজের জন্য, দিঘীর জল শুকায় না তবুও। উপরের কাহিনীটি নিছক কল্পনাও হতে পারে, অথবা কোন শিশু ডুবে যাওয়ার ঘটনা থেকে কাহিনীর জন্ম হয়েছে হয়ত।

প্রতিবছর শিব চতুর্দশীতে দুইদিনব্যাপী বিরাট মেলা বসে এখানে। প্রচুর তীর্থযাত্রীর সমাগম ঘটে এই মেলায়। তারা ছোট যমুনায় স্নান করে শিবপূজা করে। অনেক অনেক বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা।

তথসুত্র:

১. উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তি, অক্ষয়কুমার মৈত্র, প্রবাসী, কার্তিক, ১৩১৫
২. প্রাচীন বাংলার ধুলোমাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)