গোকুল মেধ/মেড় বা বেহুলা লখিন্দরের বাসরঘর

মহাস্থানগড় (পুন্ড্রনগর) থেকে ৪ কি:মি: দক্ষিণ-পশ্চিমে গোকুল ইউনিয়নের গোকুল, রামশহর ও পলাশবাড়ি মৌজার সংযোগস্থলে এই আশ্চর্যময় প্রত্নস্থানটি অবস্থিত।




১৯৩৪ - ৩৫ এবং ১৯৩৫ - ৩৬ অর্থবছরে গোকুল মেধে খননকার্য পরিচালনা করা হয়। এসময় কাদামাটিতে গাঁথা ইট নির্মিত এমন একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ বেরিয়ে আসে যেটি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত। নিচের অংশ মঞ্চ এবং ওপরের অংশ মন্দির। এখানে দুটি পুনর্নিমাণসহ একটি মূল নির্মাণামলের চিহ্ন পাওয়া যায়। দৈর্ঘ্যে ৭২ মিটার ও প্রস্থে ৫০ মিটার আয়তনের এই স্থাপনাটিতে পাওয়া গেছে ১৭২ টি কুঠুরি বা প্রকোষ্ঠ। সবগুলো কুঠুরি মাটি দিয়ে ভরাট করা। নিচ থেকে ধাপে ধাপে বিন্যস্ত কুঠুরিগুলো একটি চমৎকার স্থাপনার কাঠামো নির্দেশ করে। এটি হলো স্থাপনাটির মঞ্চ অংশ। উপরের মূল নির্মাণামলের অংশটি এমনভাবে ধ্বংস হয়েছে যে সেটির পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি।

প্রথম নির্মাণামলের চূড়ার উপরের পুরনো অংশটির উপর পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বিভাবি বিন্যস্ত একটি সারিতে পরপর তিনটি চৌকা কোঠা নির্মিত হয়েছিল। উভয় কোঠায় কেবল পশ্চিম দিকে একটি করে দরজা ছিল, অর্থাৎ স্থাপনাটি পশ্চিমমুখী ছিল। সেটির সামনের অংশে একটি মন্ডপ ও পেছনে একটি গর্ভগৃহ বা মূর্তিকোঠা ছিল। দ্বিতীয় পুনর্নিমাণকালে দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়ে মেঝের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। মেঝের মাঝখানে ৮.১৩ বর্গমিটার আয়তনের চৌবাচ্চার মত অংশ পাওয়া গিয়েছে।

সম্ভবত গুপ্ত যুগের শেষ পর্যায়ে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ক্রুশাকারে ভিত্তির উপর ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া ভরাট কক্ষগুলির শীর্ষে একটি বৌদ্ধস্তুপ নির্মিত হয়েছিল। পালযুগের কোন এক সময় স্তুপটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে একাদশ – দ্বাদশ শতাব্দীতে স্তুপটির উপরে একটি শিবমন্দির স্থাপিত হয়।



মন্দিরের ভগ্নাবশেষ খনন করে একটি নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। ভেতরে পাওয়া গিয়েছে ১২ ফুট ৮ ইঞ্চি বা ৩.৮৬ মিটার পরিধির কক্ষ, যার মাঝখানে একটি ১ ফুট ৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ১ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থ বিশিষ্ট প্রস্তরখন্ড পাওয়া গেছে। মাঝখানে একটি বড় গর্ত এবং চারপাশে ১২ টি গর্ত পাওয়া গিয়েছে। মাঝখানের গর্তটিতে আবিস্কৃত হয়েছে ৬.৪৫ বর্গ সে.মি. আকারের একটি স্বর্ণপাত্র, যাতে উপবিষ্ট নন্দীর প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ রয়েছে। এ থেকে স্থানটিতে শিবমন্দিরের অবস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।





অনেক ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি পুন্ড্রনগরের পাহারা চৌকি বা ওয়াচ টাওয়ার হিসেবে মনে করেন। পুন্ড্রনগরের সন্নিকটে অবস্থিতি ও বিশেষ ধরণের স্থাপত্যশৈলী এরূপ ধারণার কারণ। আবার হিউয়েন সাং এর ভ্রমণকাহিনীতে গোকুল মেধকে বৌদ্ধবিহার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেটা অত্যন্ত গ্রহনযোগ্য বলে মনে হয়। হয়ত এটি একটি বৌদ্ধবিহার যা পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে শিবমন্দিরে পরিণত হয়।


(Photo Credit: Najmul Huda - https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=51774398)

লোকশ্রুতি অনুযায়ী এই স্থানকে বেহুলা লখিন্দরের বাসরঘর হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ কারণে গোকুল মেধের আরেকটি প্রচলিত নাম লখিন্দরের বাসরঘর।

গোকুল মেধ এর প্রকোষ্ঠাকৃতির নির্মাণশৈলীকে ড: নাজিমুদ্দিন আহমদ উত্তর প্রদেশের বেরেলি জেলায় অবস্থিত অহিচ্ছত্রের প্রাচীন স্থাপনার সাথে তুলনা করেছেন।

তবে সব মিলিয়ে গোকুল মেধ নিঃসন্দেহে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।


(Photo Credit: Azim Khan Ronnie - https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=82561065)



(Photo Credit: Azim Khan Ronnie - https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=82561066)


তথ্য ঋণঃ
১. মহাস্থান, মোঃ মোশারফ হোসেন ও মোঃ বাদরুল আলম ২. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান ৩. বাংলাপিডিয়া

Comments

Popular posts from this blog

জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

হারিয়ে যাওয়া রামাবতী নগরী: কিছু কথা