গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়


(Photo Credit: Afifa Afrin: https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=51826261_


গোবিন্দ ভিটা একটি খননকৃত প্রত্নস্থল যা বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় (পুন্ড্রনগরী) এর উত্তর পরিখার উত্তর তীরে অবস্থিত, জাহাজঘাটা থেকে কয়েকশো গজ দূরে। এ প্রত্নস্থলের পূর্ব ও উত্তর পার্শ্ব দিয়ে করতোয়া নদী প্রবাহিত (পুরাণ ও মহাভারতে করতোয়াকে বলা হয়েছে পূণ্যতোয়া)

গোবিন্দ ভিটা শব্দের অর্থ গোবিন্দ (হিন্দু দেবতা) তথা বিষ্ণুর আবাস। কিন্তু বিষ্ণু মন্দিরের কোনো নিদর্শন এ স্থানে পাওয়া যায়নি। তবুও প্রত্নস্থলটি স্থানীয়ভাবে গোবিন্দ ভিটা নামে পরিচিত। তবে পুণ্ড্রনগরে স্কন্দ ও গোবিন্দ মন্দির যে ছিল তার উল্লেখ প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে পাওয়া যায় এবং এই মন্দিরদুটির খ্যাতি বাংলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। করতোয়া মাহাত্ম্যে বলা হয়েছে:

স্কন্দগোবিন্দয়োর্ম্মধ্যে সোমবারে কুহূতিথৌ। প্রাতরুত্থায় যঃ স্নায়াৎ কুলকোটিং সমুদ্ধরেৎ।।

অর্থাৎ, পুণ্ড্রনগরের স্কন্দ ও গোবিন্দ মন্দিরের মধ্যবর্তি স্থানে করতোয়া নদীতে পৌষনারায়ণী যোগে স্নান করলে অশেষ পুণ্য অর্জন হয়। পুণ্ড্রনগরের সেই স্কন্দ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আজো স্কন্দের ধাপে মাটির নিচে ঘুমিয়ে রয়েছে। আর স্কন্দের ধাপ ও গোবিন্দ ভিটার মধ্যবর্তী শিলাদেবীর ঘাটে (শিলাদ্বীপ থেকে বিবর্তিত নাম} শত বছরের পুরনো ঐতিহাসিক পৌষনারায়ণী মেলা আজো অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং, গোবিন্দ ভিটায় যে একসময় যে গোবিন্দ মন্দির ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রকৃতপক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা যায় যে, গোবিন্দ ভিটায় কয়েকটি নির্মাণ কালের নিদর্শন পাওয়া গেছে - সর্বশেষ নির্মাণকাল ছিল মুসলিম যুগের। তাই উৎখননে গোবিন্দ মন্দিরের নিদর্শন না-ও পাওয়া যেতে পারে।

রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থ থেকে জানা যায়, কাশ্মীররাজ ললিতাদিত্য এর পৌত্র জয়াপীর (৭৭৯ - ৮১৩ খ্রি) গঙ্গার ওপারে সৈন্যবাহিনী লুকিয়ে রেখে ছদ্মবেশে পুণ্ড্রনগরে আসেন। পুণ্ড্রের সৌন্দর্য, বিশেষ করে স্কন্দ ও গোবিন্দ মন্দির তাঁকে মুগ্ধ করে। স্কন্দের মন্দিরে সন্ধ্যারতির সময় সেবাদাসী কমলার নাচ দেখে জয়াপীর বিমোহিত হন এবং কমলার প্রেমে পড়েন। জয়াপীর এক রাতে একটি সিংহ মেরে পুণ্ড্রের রাজা জয়ন্তের সুনজরে আসেন। জয়ন্ত জয়াপীরের পরিচয় পেয়ে তাঁর কন্যা ললিতার সাথে বিয়ে দেন। জয়াপীর নিজের বাহুবলে শ্বশুর জয়ন্তকে পঞ্চগৌড়েশ্বর করেন। কাশ্মীর ফিরে যাওয়ার সময়ে তিনি কমলাকেও রানী করে নিয়ে যান।

লঘুভারতে বলা হয়েছে মানসিংহ কামরূপ হতে ফিরে যাওয়ার সময় পুণ্ড্রনগরে আসেন এবং অনেক লুপ্ত তীর্থ সনাক্ত করেন। এর মধ্যে স্কন্দ, গোবিন্দ মন্দির আর শিলাদ্বীপ উল্লেখ্য। প্রায় সবকটি তীর্থ ও মন্দিরকে তিনি অতি করুণ অবস্থায় দেখতে পান ও ব্যথিত হন।

প্রাচীন গ্রন্থের ভিত্তিতে আজকের গোবিন্দ ভিটাকে সনাক্ত করতে কোন অসুবিধাই হয় না।

গোবিন্দ ভিটা প্রত্নস্থলটি ১৯২৮–২৯ সালে কে. এন দীক্ষিত খনন করেছিলেন। ১৯৬০ সালে ড. নাজিমউদ্দীন আহমদ এখানে একটি গভীর খাদ খনন করেন।

দীক্ষিতের খননে পূর্ব ও পশ্চিমে পাশাপাশি অবস্থিত দুসেট মন্দির এবং পরপর চারটি যুগের নিদর্শনসমূহ পাওয়া গিয়েছে। (১) পশ্চিম পাশে রয়েছে পরবর্তী গুপ্তযুগে (৬ষ্ঠ - ৭ম শতক) নির্মিত বারান্দাযুক্ত একটি মন্দির যার ভিত্তিভূমি অত্যন্ত গভীর এবং অফসেট যুক্ত। (২) পশ্চিম পাশেই প্রাথমিক পাল যুগে (৮ম - ৯ম শতক) প্রতিষ্ঠিত একটি বারান্দাযুক্ত মন্দির রয়েছে যার ভিত্তি স্তরে স্তরে উঁচু করে নির্মিত হয়েছিল। (৩) পশ্চিম পাশের এ উঁচু ভিত্তিটি পরবর্তী পাল ও সেন যুগে এবং এমন কি মুসলমানদের সময়েও ব্যবহূত হয়েছিল।



(Photo Credit: Ekela rajkumar: https://commons.wikimedia.org/w/index.php?curid=51871049)





মন্দিরের পাশে একটি চন্ডীদেবীর প্রস্তর প্রতিমা (১১ শতক) এবং একটি নৃত্যরত গণেশের প্রস্তর প্রতিমা (১১ শতক) পাওয়া গিয়েছে। (৪) পশ্চিম পাশের মন্দিরের উপরে মুসলিম তথা সুলতানি যুগে (১৫ - ১৬ শতক) নির্মিত একটি ইটের প্লাটফর্ম আবিষ্কৃত হয়েছে।

গোবিন্দ ভিটার পূর্ব পাশের মন্দির অংশে সুস্পষ্ট চারটি যুগের সাংস্কৃতিক নিদর্শনসমূহ আবিষ্কৃত হয়েছে। যথা: (১) পরবর্তী গুপ্ত যুগে নির্মিত বর্গাকৃতির মন্দির যার মধ্যে প্রদক্ষিণপথ বেষ্টিত একটি আয়তাকার ডায়াস রয়েছে। (২) প্রাথমিক পাল যুগে নির্মিত একটি কমপ্লেক্স এবং বহুপার্শ্ব বিশিষ্ট প্রস্তর বেদি। (৩) পরবর্তী পাল যুগে নির্মিত কিছু ক্ষয়িষ্ণু দেওয়াল এবং একটি সম্ভাব্য অগ্নিশিলা। মুসলিম তথা সুলতানি যুগে নির্মিত একটি ভগ্ন মেঝের মধ্যে ১৮টি মুদ্রা ভর্তি একটি মাটির পাত্র। মুদ্রাগুলি বাংলার সুলতানগণ জারি করেছিলেন।

উল্লেখ্য, প্রাথমিক পাল যুগেই দুটি মন্দির ঘিরে একটি সাধারণ বেষ্টনী প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া মন্দির সংলগ্ন নদীর তীরে এ যুগে নির্মিত পাথরের রক্ষা বাঁধ বা রক্ষা প্রাচীর এবং একটি পাথরের বাঁধানো ঘাট ছিল যা ১৯২২ সালের প্লাবনে ভেসে গিয়েছে।



গোবিন্দ ভিটায় ১৯৬০ সালের গভীর খাদ খননের ফলে আবিষ্কৃত হয় মৌর্যযুগের ছাপাংকিত ও ঢালাই করা রৌপ্য মুদ্রা এবং উত্তরাঞ্চলীয় কালো চক্চকে মৃৎপাত্র, অর্ধ-ডজন শূঙ্গযুগের (খ্রি.পূ. ২য়-১ম অব্দ) পোড়ামাটির ফলক, একটি খোদাইকৃত নীল পাথরের চাকতি আকৃতির প্রসাধনী ট্রে (খ্রি. ১ম-২য় শতক), একটি কাদা মাটির তৈরী সীলমোহর ও পোড়ামাটির মস্তক (৪র্থ শতাব্দী), তিনটি বৃহৎ মাটির পাত্র বা ভাট (খ্রিস্টীয় ৬-৭ শতক) যাতে শঙ্খখোসা ও চুন এবং নরকংকাল ছিল।

এখানে প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিভিন্ন আকৃতির ও ধরনের পোড়ামাটির দ্রব্য, স্বল্পমূল্যের পাথরের তৈরী গুটিকা ও বোতাম, কানবালা ও কুন্তল, নাকফুল ইত্যাদি। এ ছাড়া, পোড়ামাটির মূর্তি ও খেলনা এবং তামা ও ব্রোঞ্জের তৈরী বলয় এবং সুরমা দন্ডও পাওয়া গিয়েছে।


করতোয়া নদী

তথ্যসূত্র:

১. পুন্ড্রবর্ধন, বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য
২. করতোয়া মাহাত্ম্য
৩. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)