ভীমের পান্টি বা গড়ুর স্তম্ভ বা বাদাল প্রশস্তি, মঙ্গলবাড়ি, নওগাঁ

প্রথমেই বলে রাখি 'পান্টি' শব্দটি বরেন্দ্রভূমির একটি আঞ্চলিক শব্দ, যার অর্থ গরু-ছাগল মাঠে চরানোর সময় রাখালদের ব্যবহৃত লাঠি। প্রকৃতপক্ষে ভীমের পান্টি একটি গরুড় স্তম্ভ। এটির অপর নামগুলি হল "বাদাল স্তম্ভ", "গরুড় স্তম্ভলিপি", "বাদাল প্রশস্তিলিপি" এবং "বাদাল শিলালেখ"। এটি সমগ্র বাংলায় প্রাপ্ত দীর্ঘ শিলালেখগুলির অন্যতম। পাল আমলের অনেক তথ্যবাহী এ শিলালেখ বাংলার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রামাণিক দলিল।


বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার একেবারে পূর্বপ্রান্তে জয়পুরহাট জেলার সীমানা ঘেঁষে জাহানপুর ইউনিয়নে মুকুন্দপুর-হরগৌরী এলাকার হরগৌরী মন্দিরটি বেশ খ্যাতিসম্পন্ন। একটি সুউচ্চ মাটির ঢিবির (বেড় ১৭০ মিটার ও উচ্চতা ১০ মিটার) উপরে হরগৌরী মন্দিরটি অবস্থিত। বর্তমান মন্দিরটি হাল আমলে তৈরী এবং পুরনো মন্দিরের ভিত্তি প্রাচীরের চিহ্ন এখনো চোখে পড়ে ঢিবির উপরে। এ মন্দিরটির আশেপাশে ১৪ টি বিভিন্ন আকারের পুকুর রয়েছে। এর মধ্যে একটি পুকুর “অমৃতকুন্ড” ও অপরটি “কোদাল ধোয়া” নামে পরিচিত।

মন্দিরের ঢিবিটি বেশ সুপ্রাচীন তা এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য খোলামকুচি ও ভাঙা ইটের টুকরো দেখেই বোঝা যায়। ঢিবির মাটি যেখানেই একটু সরে গিয়েছে, সেখানেই ইটের দেয়ালের অংশ চোখে পড়ে। নিশ্চিতভাবে প্রাচীন মন্দিরের ভগ্নাবশেষের উপরে নতুন হরগৌরী মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। 



জনশ্রুতি অনুসারে, জঙ্গলাকীর্ণ এ স্থানে কয়েকশত বছর আগে বীরেশ্বর ব্রহ্মচারী নামের একজন সাধক এসে ঢিবিটি পরিস্কার করে বসবাস শুরু করেন। সেসময় তিনি এখানে হরগৌরী মন্দিরটি স্থাপন করেন এবং মন্দিরে ঢিবি পরিস্কারকালে পাওয়া একটি কালো পাথরের হরগৌরী মূর্তিটির পূজা শুরু করেন। বীরেশ্বর সাধুবাবার তিরোধানের পর জায়গাটি আবারো পরিত্যক্ত হয়ে জঙ্গলে ঢেকে যায়।

১৯৭৮ সালে বীরেশ্বর ব্রহ্মচারীর স্থাপিত উক্ত পুরনো ধ্বংস হয়ে যাওয়া মন্দির থেকে চোকলাতলা কালো পাথরের একটি উমা মহেশ্বর মূর্তি উদ্ধার করে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার জাদুঘরে রাখা হয়েছে এবং বর্তমান মন্দিরটি এ সময় পুনরায় নির্মিত হয়। 

এই মন্দিরটি থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে কালো ব্যাসাল্ট পাথরের সুউচ্চ স্তম্ভ সামান্য হেলানো অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। এ স্তম্ভটিই ভীমের পান্টি বা বাদাল স্তম্ভ নামে পরিচিত। সুউচ্চ মাটির ঢিবি এবং প্রাচীন পুকুরের উপস্থিতিই বলে দেয় এ স্থানটি সুপ্রাচীন। 



স্থানীয়দের কাছে এটি ভিমের পান্টি আবার কেউ কেউ কৈবর্ত রাজা ভিমের লাঠি বলে থাকে। দেখতে অনেকটা প্রলম্বিত মোচার মতো। কৃষ্ণাভ ধূসর প্রস্তরে (Black Basalt) নির্মিত স্তম্ভটি বর্তমানে ভগ্নাবস্থায়ও প্রায় ৩.৬ মিটার উঁচু, এবং নিচের দিকে এর পরিধি ১.৭৬ মিটার। স্তম্ভটি আদিতে আরও অনেক উঁচু ছিল এবং এর চূড়ায় একটি গরুড় মূর্তি ছিল। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার বজ্রপাতে মূর্তিসহ উপরের অংশ ভেঙ্গে গেছে এবং স্তম্ভটি একদিকে কিছুটা হেলে পড়েছে। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, স্তম্ভটির নীচের দিকে রয়েছে দশম শতকের সিদ্ধং লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় লেখা ২৮ লাইনের এক সুবৃহৎ শিলালিপি। প্রতিটি লাইন দৈর্ঘ্যে প্রায় ২১ ইঞ্চি ও প্রস্থে ০.৫৩ ইঞ্চির মতো। মূল ব্রাহ্মী থেকে উদ্ভূত এই সিদ্ধং লিপির পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকেই বর্তমান বাংলা লিপির উদ্ভব। পাল আমলে বাংলায় এই সিদ্ধং লিপিই প্রচলিত ছিল। স্তম্ভের গায়ে বজ্রলেপ ছিল। তা স্থানে স্থানে উঠে গেলেও স্তম্ভটির গাত্র এখনো মসৃণ। 

প্রথমে ভীমের পান্টি সম্পর্কে স্থানীয় বহুল জনশ্রুতিটি আগে বলছি। মহাভারতের পঞ্চপান্ডবের দ্বিতীয় পান্ডব ভীমের সাথে স্তম্ভটির সম্পর্ক আছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বারণাবতে জতুগৃহ কাণ্ডের পরে পঞ্চপাণ্ডব মা কুন্তিকে নিয়ে যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন‚ ওই সময় ভীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হিড়িম্বা রাক্ষসীর। হিড়িম্বার ইচ্ছা পূর্ণ করতে ভীম তাকে বিবাহ করেন। শর্ত ছিল‚ হিড়িম্বার একটি পুত্রসন্তান না হওয়া পর্যন্ত ভীম তাঁকে সঙ্গ দেবেন। হিড়িম্বা এরপর ভীমকে নিয়ে আকাশপথে এই অঞ্চলে এসে পৌঁছান। এখানে মানুষ তখন চাষবাস জানত না, বলতে গেলে বিরান ভূমি চারিদিকে। তাই দেখে ভীম পতিত জমি উদ্ধার করে চাষবাস শুরু করেন। কিছুদিন পরে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচের জন্ম হল। শর্ত অনুসারে ভীমও ফিরে গেলেন ভাইদের কাছে। তবে যাবার আগে তাঁর গরু চরাবার লাঠি বা পান্টি মাঠের মাঝে গুঁজে রেখে গেলেন। মহাবলী ভীমের সেই গাছের গুঁড়ির মতো লাঠি কালক্রমে পাথরে পরিণত হলেও আজও তেমনই পোঁতা রয়েছে।



এটি একটি জনশ্রুতি হলেও এ গল্পে ইতিহাসের একটি ক্ষুদ্র প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত মনে আসে। বহিরাগত কোন শিল্পীর হাতে স্মরণাতীত কালে এ সুবিশাল পাথরের স্তম্ভ তৈরী ও সেটিকে স্থাপনের কথা মনে আসে। বরেন্দ্রে পাথর চিরকাল দূর্লভ এবং এটি বাহির থেকেই আনা হয়েছে সবসময়। তাই এ অনার্য ভূমিতে [অন্তত মহাভারত তো তেমনই বলে] মথুরা বা সুদূর কোন পশ্চিম দেশ থেকে কোন শিল্পী [ভীমের ন্যায় রূপকল্প] এ দেশে এসে এমন বিস্ময় জাগানিয়া স্তম্ভ নির্মাণ এবং কাজশেষে প্রত্যাগমনের কাহিনি এটি। এমন সময় স্থানীয় নারীর [হিড়িম্বা] প্রণয় ঘটিত ঘটনা থাকতে পারে। মহাভারতের ভীম হিড়িম্বা ও ঘটোৎকচকে যেমন রেখে যায়, এ শিল্পীও ঠিক তেমনটিই করেছে। ভীম ও হিড়িম্বারা যুগে যুগে আসে নানারূপে।

যাক, এখন ইতিহাসের কথা বলি। ভীমের পান্টি বা বাদাল স্তম্ভের প্রথম আবিষ্কারক তৎকালীন দিনাজপুর জেলার বাদাল নামক স্থানের নীলকুঠির অধ্যক্ষ স্যার চার্লস উইলকিন্স। উল্লেখ্য ভীমের পান্টি  থেকে তিন মাইল দূরে বাদাল নামক জায়গাটি এখনো আছে। যাইহোক, ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দের শীতকালে  কুঠির সাহেব শিকারে বেড়িয়ে হঠাৎই জঙ্গলের মধ্যে এ স্তম্ভটি দেখে অবাক হয়ে যান। এরপর মালদহের নীলকুঠীর অধ্যক্ষ জৰ্জ উডনী ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে এবং মালদহের অন্তর্গত গুয়ামালতী কুঠীর অধ্যক্ষ ক্রেটন সাহেব ১৭৮৬ খৃষ্টাব্দে এ স্তম্ভটি পরিদর্শন করেন এবং নিজেদের নাম এর গায়ে লিখে যান। 

স্যার উইলকিন্স নিজের চেষ্টায় স্তম্ভের গায়ের লেখার অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেন এবং যেটুকু অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন তা ১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এরপর ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে দিনাজপুরের কালেক্টর ওয়েষ্টমেকট এ শিলালেখ পাঠের চেষ্টা করে কিঞ্চিৎ সফল হন। অবশেষে অধ্যাপক কিলহর্ণ এবং তারপর বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সম্পূর্ণ লিপিটির অর্থোদ্ধার করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলার অজানা এক বিরাট অধ্যায় উন্মোচিত হয়।



অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় যে অর্থ উদ্ধার করেছিলেন, নীচে হুবহু সেটি উদ্ধৃত করলাম এবং এরপরেই আরো বিস্তারিত বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। অনুবাদে বন্ধনীযুক্ত শব্দ বা অর্থগুলি মৈত্রেয় মশায়ের দেওয়া।

বাদাল স্তম্ভের বাংলা অনুবাদ:

১. শান্ডিল্য বংশে (বিষ্ণু?) তদীয় অন্বয়ে বীরদেব, তদগোত্রে পাঞ্চাল এবং পাঞ্চাল হইতে (তৎপুত্র) গর্গ জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।

২. সেই গর্গ বৃহস্পতিকে এই বলিয়া উপহাস করিতেন যে – (শত্রু) ইন্দ্রদেব কেবল পূর্বদিকেরই অধিপতি, দিগন্তরের অধিপতি ছিলেন না (কিন্তু বৃহস্পতির মত মন্ত্রী থাকিতেও) তিনি সেই একটি মাত্র দিকেও (সদ্য) দৈত্যপতিগণ কর্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন, (আর) আমি সেই পূর্বদিকের অধিপতি ধর্ম (নামক) নরপালকে অখিল দিকের স্বামী করিয়া দিয়াছি।

৩. নিসর্গ- নির্মল- স্নিগ্ধা চন্দ্রপত্নী কান্তিদেবীর ন্যায়, অর্ন্তবিবর্তিনী ইচ্ছার অনুরূপা, তাহার ইচ্ছানাম্নী পত্নী ছিলেন।

৪. বেদচতুষ্টয়রূপ- মুখপদ্ম- লক্ষণাক্রান্ত, স্বাভাবিক উৎকৃষ্ট পদগৌরবে ত্রিলোকশ্রেষ্ঠ, কমলযোনি ব্রহ্মার ন্যায়, তাহাদের দ্বিজোত্তম পুত্র নিজের শ্রীদর্ভপাণি এই নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন।

৫. সেই দর্ভপাণির নীতি কৌশলে শ্রীদেবপাল (নামক) নৃপতি মতঙ্গজ- মদাভিষিক্ত শিলাসংহতিপূর্ণ রেবা (নর্মদা) নদীর জনক (উৎপত্তিস্থান বিন্ধ্য পর্বত) হইতে (আরম্ভ করিয়া) মহেশ-ললাট-শোভি-ইন্দু-কিরণ- শ্বেতায়মান গৌরীজনক (হিমালয়) পর্বত পর্যন্ত, সূর্যোদয়াস্ত কালে অরুণরাগ-রঞ্জিত (উভয়) জলরাশির আধার পূর্ব-সমুদ্র এবং পশ্চিম-সমুদ্র (মধ্যবর্তী) সমগ্র ভূভাগ কর-প্রদ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

৬. নানা- মদমত্ত- মতঙ্গজ- মদবারি- নিষিক্ত- ধরণিতল- বিসর্পি ধূলিপটলে দিগন্তরাল সমাচ্ছন্ন করিয়া দিকচক্রাগত- ভূপাল বৃন্দের চিরসঞ্চারমানে যাহাকে নিরন্তর দুর্বিলোক করিয়া রাখিত, সেই দেবপাল (নামক) নরপাল (উপদেশ গ্রহণের জন্য) দর্ভপাণির অপেক্ষায়, তাহার দ্বারদেশে দণ্ডায়মান থাকিতেন।

৭. সুররাজ কল্প (দেবপাল) নরপতি (সেই মন্ত্রীবরকে) অগ্রে চন্দ্রবিম্বানুকারীকে (মহার্হ) আসন প্রদান করিয়া, নানা নরেন্দ্র-মুকুটাঙ্কিত-পাদ-পাংসু হইয়াও স্বয়ং সচকিতভাবেই সিংহাসনে উপবেশন করিতেন।

৮. অত্রি হইতে যেমন চন্দ্রের উৎপত্তি হইয়াছিল, সেইরূপ তাঁহার এবং শর্করাদেবীর পরমেশ্বর বল্লভ শ্রীমান সোমেশ্বর (নামক) পুত্র উৎপন্ন হইয়াছিল। 

৯. তিনি বিক্রমে ধনঞ্জয়ের সহিত তুলনা লাভের উপযুক্ত (উচ্চ) স্থানে আরোহণ করিয়াও, (বিক্রম প্রকাশের পাত্রাপাত্র- বিচার- সময়ে ধনঞ্জয়ের ন্যায়) ভ্রান্ত বা নির্দয় হইতেন না, তিনি অর্থিগণকে বিত্ত বর্ষণ করিবার সময়ে, (তাহাদের মুখের) স্তুতি-গীতি শ্রবণের জন্য উদগর্ব হইতেন না, তিনি ঐশ্বর্যের দ্বারা বহু বন্ধুজনকে (সংবলিগত) নৃত্যশীল করিতেন, (বৃথা) মধুর বচন প্রয়োগেই তাঁহাদিগের মনস্তুষ্টির চেষ্টা করিতেন না, (সুতরাং) এই সকল জগতবিসদৃশ-স্বগুণ গৌরবে তিনি সাধুজনের বিস্ময়ের উৎপাদন করিয়াছিলেন।

১০. শিব যেমন শিবার, (এবং) হরি যেমন লক্ষ্মীর পাণি গ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনিও সেইরূপ গৃহাশ্রম-প্রবেশ-কামনায় আত্মানুরূপা রল্লাদেবীকে যথাশাস্ত্র (পত্নীরূপে ) গ্রহণ করিয়াছিলেন।

১১. তাঁহাদিগের কেদার মিশ্র নামে তপ্ত-কাঞ্চন-বর্ণাভ- কার্তিকেয়- তুল্য (এক) পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তাঁহার (হোম কুণ্ডোত্থিত) অবক্রভাবে বিরাজিত সুপুষ্ট হোমাগ্নি-শিখাকে চুম্বন করিয়া, দিকচক্রবাল যেন সন্নিহিত হইয়া পড়িত। তাঁহার বিস্ফোরিত শক্তি দুর্দমনীয় বলিয়া পরিচিত ছিল। আত্মানুরাগ-পরিণত অশেষ বিদ্যা (যোগ্য পাত্র পাইয়া) তাহাকে প্রতিষ্ঠা দান করিয়াছিল। তিনি স্ব-কর্মগুণে দেব-নরের হৃদয়-নন্দন হইয়াছিলেন।

১২. তিনি বাল্যকালে একবার মাত্র দর্শন করিয়াই, চর্তুবিদ্যা পয়োনিধি পান করিয়া, তাহা আবার উদগীর্ণ করিতে পারিতেন বলিয়া, অগস্ত্য-প্রভাবকে উপহাস করিতে পারিয়াছিলেন।

১৩. (এই মন্ত্রবরের) বুদ্ধি-বলের উপাসনা করিয়া গৌড়শ্বর (দেবপাল দেব) উৎকল-কূল উৎকলিত করিয়া, হূণ-গর্ব খর্বীকৃত করিয়া এবং দ্রবির- গুর্জর- নাথ- দর্প- চূর্ণীকৃত করিয়া, দীর্ঘকাল পর্যন্ত সমুদ্র-মেখলা-ভরণা বসুন্ধরা উপভোগ করতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

১৪. তিনি যাচকগণকে যাচক মনে করিতেন না, মনে করিতেন তাঁহার দ্বারা অপহৃত-বিত্ত হইয়াই, তাঁহারা যাচক হইয়া পড়িয়াছে। তাঁহার আত্মা শত্রু-মিত্রে নির্বিবেক ছিল। (কেবল) ভব-জলদি- জলে পতিত হইবার ভয় এবং লজ্জা (ভিন্ন) অন্য উদ্বেগ ছিল না। তিনি (সংযমাদি অভ্যাস করিয়া) বিষয় বাসনা ক্ষালিত করিয়া, পরম-ধাম-চিন্তায় আনন্দ লাভ করিতেন।

১৫. সেই বৃহস্পতি- প্রতিকৃতি (কেদার মিশ্রের) যজ্ঞস্থলে সাক্ষাৎ ইন্দ্র তুল্য শত্রু- সংহারকারী নানা-সাগর-মেখলা-ভরণা বসুন্ধরার চির-কল্যাণকামী শ্রী শূরপাল (নামক) নরপাল, স্বয়ং উপস্থিত হইয়া, অনেকবার শ্রদ্ধা- সলিলাপ্লুত হৃদয়ে নতশিরে পবিত্র (শান্তি) বারি গ্রহণ করিয়াছিলেন।

১৬. তাঁহার দেবগ্রাম জাতা বব্বা (দেবী) নাম্নী পত্নী ছিলেন। লক্ষ্মী চঞ্চল বলিয়া, এবং (দক্ষ-দুহিতা) সতী অনপত্যা (অপুত্রবর্তী) বলিয়া, তাহাদের সহিত (বব্বা দেবীর) তুলনা হইতে পারে না।

১৭. দেবকী গোপাল-প্রিয়কারক পুরুষোত্তম তনয় প্রসব করিয়াছিলেন, যশোদা সেই লক্ষীপতিকে (আপন পুত্ররূপে) স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। বব্বা দেবীও, সেইরূপ, গোপাল-প্রিয়কারক পুরুষোত্তম তনয় প্রসব করিয়াছিলেন, যশো-দাতারা তাহাকে লক্ষ্মীর পতি বলিয়াই স্বীকার করে লইয়াছিলেন।

১৮. তিনি জমদগ্নিকূলোৎপন্ন সম্পন্ন-ক্ষত্র-চিন্তক (অপর) দ্বিতীয় রামের (পরশুরামের) ন্যায়, রাম (অভিরাম) গুরুব মিশ্র এই আখ্যায় (পরিচিত ছিলেন)

১৯. (পাত্রাপাত্র- বিচার) কুশল গুণবান বিজিগীষু শ্রীনারায়ণ পাল (নরপতি) যখন তাহাকে মাননীয় মনে করতেন, তখন আর তাঁহার অন্য (প্রশস্তি ) প্রশংসা বাক্য কি (হইতে পারে?)।

২০. তাঁহার বাগবৈভবের কথা, আগমে ব্যুৎপত্তির কথা, নীতিতে পরম নিষ্ঠার কথা, মহতের গুণ-কীর্তনে আসক্তির কথা, জ্যোতিষে অধিকারের কথা এবং বেদার্থ-চিন্তা-পরায়ণ অসীম-তেজসম্পন্ন তদীয় বংশের কথা, ধর্মাবতার ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন।

২১. সেই শ্রীভৃৎ (ধনাঢ্য) এবং বাগধীশ (সুপণ্ডিত) ব্যক্তিতে একত্র মিলিত হইয়া, পরস্পরের সখ্য-লাভের জন্যই, স্বাভাবিক শত্রুতা পরিত্যাগ করিয়া, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী উভয়েই যেন (একত্র) অবস্থিতি করিতেছেন।

২২. শাস্ত্রানুশীলন-লব্ধ-গভীর-গুণ-সংযুক্ত বাক্যে (তর্কে) তিনি বিদ্বৎ সভায় প্রতিপক্ষের মদগর্ব চূর্ণ করিয়া দিতেন, এবং যুদ্ধক্ষেত্রেও অসীম-বিক্রম- প্রকাশে, অল্পক্ষণের মধ্যেই, শত্রুবর্গের ভটাভিমান (যোদ্ধা বলিয়া অভিমান) বিনষ্ট করিয়া দিতেন।

২৩. যে বাক্যের ফল তৎক্ষণাৎ প্রতিভাত হইত না, তিনি সেরূপ (বৃথা) কর্ণ-সুখকর বাক্যের অবতারণা করতেন না। যেরূপ দান পাইয়া (অভীষ্ট পূর্ণ হইল না বলিয়া) যাচককে অন্য ধনীর নিকট গমন করিতে হয়, তিনি কখনও সেরূপ (কেলি- দানের) দান- ক্রীড়ায় অভিনয় করিতেন না।

২৪. কলিযুগ-বাল্মীকির জন্ম-সূচক, অতি রোমাঞ্চোৎপাদক, ধর্মেতিহাস-গ্রন্থ-সমূহে, সেই পুণ্যাত্মা শ্রুতির বিবৃতি (ব্যাখ্যা) করিয়াছিলেন।

২৫. তাঁহার সুর-তরঙ্গিণীর ন্যায় অ-সিন্ধু-গামিনী প্রসন্ন-গম্ভীরা বাণী (জগৎকে) যেমন তৃপ্তিদান করিত, সেইরূপ পবিত্র করিত।

২৬. তাঁহার বংশে ব্রহ্মা স্বয়ং পিতৃত্ব গ্রহণ করিয়া, আবার স্বয়ং পুত্ররূপে জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন, (ইতি) এইরূপ মনে করিয়া (লোকে) তাঁহার পূর্বপুরুষগণের এবং তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করিত।

২৭. তাঁহার (সুকুমার) শরীর-শোভার ন্যায় লোক-লোচনের আনন্দদায়ক, তাঁহার উচ্চান্তকরণের অতুলনীয় উচ্চতার ন্যায় উচ্চতা-যুক্ত, তাঁহার সুদৃঢ় প্রেম-বন্ধনের ন্যায় দৃঢ় সংবদ্ধ, কলি-হৃদয়-প্রোথিত-শল্যবৎ সুস্পষ্ট (প্রতিভাত) এই স্তম্ভে, তাঁহার দ্বারা হরির প্রিয়সখা ফণিগণের (শত্রু) এই গরুড়মূর্তি (তার্ক্ষ্য) আরোপিত হইয়াছে।

২৮. তাঁহার যশ অখিল দিগন্ত পরিভ্রমণ করিয়া, এই পৃথিবী হইতে পাতাল-মূল পর্যন্ত গমন করিয়া, (আবার) এখানে হৃতাহি- গরুড়চ্ছলে উত্থিত হইয়াছে। (এই) প্রশস্তি সূত্রধার বিষ্ণুভদ্র কর্তৃক উৎকীর্ণ হইয়াছে। 

উপরের অনুবাদ থেকে বাংলার ইতিহাসের অনেক অজানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। 

প্রথমেই আসি কে এই লিপি উৎকীর্ণ করলো এবং কেন করলো? বাদাল স্তম্ভের শিলালেখ নিঃসন্দেহে একটি প্রশস্তি লিপি, যেটি একটি সুপণ্ডিত ব্রাহ্মণ বংশের গুণকীর্তন নিয়ে লিখিত। লিপির ১৮ নং শ্লোকে আমরা উৎকীর্ণকারীর নাম পাই গুরবমিশ্র বা ভট্টগুরব এবং ২৮ নং শ্লোকে শিল্পীর নাম জানতে পারি – বিষ্ণুভদ্র, যিনি নিজেকে সূত্রধর বলছেন।



ভট্টগুরব ও তাঁর পূর্বপুরুষরা পাল সাম্রাজ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবে মর্যাদাশালী ছিলেন। এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই; কেননা আমরা রাজমন্ত্রীর কোন বংশাবলীর বিবরণ সম্বলিত এরূপ দীর্ঘ শিলালেখ কোথাও দেখতে পাই না। বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাসনামলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদাসীন ব্যক্তিই এমন শিলালেখ স্থাপন করতে পারেন। 

বাদাল স্তম্ভলিপিটি নারায়ণপালের রাজত্বকালে (৮৫৪ - ৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ) স্থাপিত হয়েছিল, কারণ ১৯ নং শ্লোকে নারায়ণপাল সর্বশেষ নরপতি, যাঁর কথা বলা হয়েছে এবং ভট্টগুরব নারায়ণপালের মন্ত্রী ছিলেন সেটিও বোধগম্য হয়। নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রশাসনেও ভট্টগুরবকে 'প্রিয়পাত্র' [দূতক] বলে অভিহিত করা হয়েছে। সে হিসেবে বাদাল শিলালেখ ১১০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন বলে ধরে নেওয়া যায়। 

এখন আসি পরের কথায়। ভট্টগুরব নিজেদের শাণ্ডিল্য গোত্র ও 'জমদগ্নিকুলোদ্ভব' বলেছেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এ বংশকে রাঢ়ী-বারেন্দ্র-ব্রাহ্মণ সমাজের শাণ্ডিল্য গোত্র থেকে আলাদা বলে মত দিয়েছেন। আমরা প্রশস্তিলিপি থেকে ভট্টগুরবের যে পূর্বপুরুষদের নাম পাই: ১. গর্গ ২. দর্ভপাণি ৩. সোমেশ্বর ৪. কেদারমিশ্র ও ৫. ভট্টগুরব। এঁরা সকলেই অতি সুপণ্ডিত শাস্ত্রজ্ঞ, প্রবল প্রভাবশালী এবং একাধিক পাল রাজাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন।  

প্রবল শক্তিশালী পাল সম্রাটগণ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের প্রধান অমাত্য হিন্দু ব্রাহ্মণ হওয়ার সাক্ষ্য দেয় এ প্রশস্তিলিপি। শুধু তাই নয়, ৫ ও ৭ নং শ্লোক থেকে আমরা জানতে পারি যে, পালরাজগণ [দেবপাল ও মহেন্দ্রপাল যথাক্রমে] দর্ভপাণির দ্বারে অপেক্ষমান থাকতেন তাঁর সময় পাওয়ার জন্য এবং সিংহাসনে উপবেশন করতেন 'সচকিত' ভাবে। অন্যান্য শ্লোকগুলিও পাল নরপতিগণের রাজ্য বিস্তারে ভট্টগুরবের পূর্বজদের কূটনীতি ও রণনীতিতে অবদান ঘোষণা করছে। এ বিষয়টি আমাদের কৌটিল্য বা চাণক্যের কথা মনে করিয়ে দেয়, যাঁকে আমরা Kingmaker বলে জানি, যিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে রাজাধিরাজ বানিয়েছেন বলে ইতিহাসে প্রচলিত। চন্দ্রগুপ্তের যেমন চাণক্য, পাল নৃপতিদের তেমনি ভট্টগুরব ও তাঁর পূর্বজগণ।

এ প্রশস্তিলিপিতে আমরা যেসকল পাল রাজাদের উল্লেখ পাই সে বিষয়ে আলোকপাত করছি:

১. ধর্মপাল: প্রশস্তিলিপির ২য় শ্লোক থেকে আমরা জানতে পারি রাজাধিরাজ ধর্মপালদেবের মন্ত্রী ছিলেন গর্গদেব। লক্ষণীয়, দেবপালকে পূর্ব দিকের অধিপতি বলা হয়েছে, যা মূলত গৌড়দেশ তথা বাংলা; একেবারে নির্দিষ্ট করে বললে পালরাজদের শেকড় বরেন্দ্রভূমিতে প্রোথিত রয়েছে। মন্ত্রী গর্গদেবের সহায়তায় ধর্মপালের রাজ্য বিস্তারের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বিদ্যমান।

২. দেবপাল: প্রশস্তিলিপির ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্লোকে আমরা দেবপাল ও তাঁর মন্ত্রী দর্ভপাণি সম্পর্কে জানতে পারি। দর্ভপাণির সহায়তায় দেবপাল আসমুদ্রহিমাচল বিশাল ভূখণ্ডের অধিপতি হন। দর্ভপাণির সুপরামর্শ গ্রহনের জন্য দেবপাল অপেক্ষমান থাকতেন বলে জানা যাচ্ছে। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত থেকে আমরা জানতে পারি, পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল নৃপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তার মানে, সে সময় সমাজপতি বা সামন্তগণ নৃপতির ক্ষমতা লাভের পেছনে কাজ করতেন। সে হিসেবে ব্রাহ্মণমন্ত্রী দর্ভপাণি যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন পাল সাম্রাজ্যের উপরে। 

৩. মহেন্দ্রপাল: জগজ্জীবনপুরে চতুর্থ পাল নৃপতি মহেন্দ্রপালের তাম্রলেখ আবিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত মহেন্দ্রপাল সম্পর্কে কিছু জানা ছিল না ইতিহাসবিদদের। বাদাল শিলালেখের পাঠোদ্ধার করার সময় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও অন্যান্য গবেষকগণ ৭ম শ্লোকের "সুররাজা কল্প" বলতে দেবপালকে বুঝিয়েছেন, যেহেতু মহেন্দ্রপাল তখনো অনুদঘাটিত। কিন্তু জগজ্জীবনপুর তাম্রলেখ আমাদের মহেন্দ্রপাল সম্পর্কে জানার সুযোগ দিচ্ছে। "সুররাজা" বলতে দেবরাজ ইন্দ্রকে বুঝানো হয়, এদিকে ইন্দ্রের অপর নামও মহেন্দ্র। সে হিসেবে "সুররাজা কল্প" আর কেউ নয়, মহেন্দ্রপাল। দর্ভপাণি দেবপালের মৃত্যুর পর দেবপালপুত্র মহেন্দ্রপালের মন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ সভাসদ হিসেবে ছিলেন। দর্ভপাণির পর তাঁর পুত্র কেদারমিশ্র মহেন্দ্রপালের সভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকেন।

৪. শুরপাল: বাদাল শিলালেখের ১৫ নং শ্লোকে আমরা শুরপাল নৃপতির উল্লেখ পাই, যাঁর মন্ত্রী কেদারমিশ্র। সুপণ্ডিত কেদারমিশ্রকে এ শ্লোকে আমরা আরেকটি ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি, পুরোহিত বেশে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হয়েও শুরপাল শ্রদ্ধাবনত মস্তকে মঙ্গলময় পবিত্র যজ্ঞের বারি মাথায় নিচ্ছেন। ক্রমবর্ধমান ব্রাহ্মণ্য প্রভাবও এখানে লক্ষ্যণীয়।



৫. দ্বিতীয় গোপাল: শিলালেখের ১৭ নং শ্লোকে ভট্টগুরব মিশ্রকে "গোপাল প্রিয়কারক" বলা হয়েছে। S.C Bhattacharya মত দিয়েছেন এখানে গোপাল বলতে পাল সম্রাট দ্বিতীয় গোপালকে বুঝানো হয়েছে, যেহেতু শুরপাল ও তাঁর পরে নারায়ণপালের মাঝখানে দ্বিতীয় গোপাল পাল বংশাবলীতে যে শূণ্যস্থান আছে সেটি সঠিকভাবে পূরণ করছে।

৬. নারায়ণপাল: প্রশস্তিতে ১৯ নং শ্লোকে আমরা নারায়ণপালের উল্লেখ পাই, যাঁর মন্ত্রী ভট্টগুরব। ভাগলপুর তাম্রশাসনেও ভট্টগুরবকে নারায়ণপালের প্রিয়পাত্র উল্লেখ করা হয়েছে। পাল সম্রাটের দানশীলতার পরিচয়ও বাদাল লেখের পরবর্তী শ্লোকগুলোতে পাই। তবে বিগ্রহপালের কথা এ লিপিতে বলা হয়নি, সম্ভবত বিগ্রহপালের শাসনামল খুব অল্প সময় হওয়ার জন্য।

বাদাল স্তম্ভটির অবস্থিতি এ অঞ্চলে কেন এবং ভট্টগুরবের বাসস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে অনেক বিতর্ক রয়েছে। মন্দিরের বিশাল ঢিবিটি ছাড়া এখানে আর কোন ধ্বংসাবশেষের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। কিন্তু এ ধারণা যুক্তিযুক্ত যে, ভট্টগুরবের বাসস্থান বাদাল স্তম্ভের কাছেই কোথাও, যা কালক্রমে লুপ্ত। 

বাদাল স্তম্ভের অবস্থান যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই বলতে হয়। এ স্তম্ভ থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে প্রথম পাল সম্রাট গোপালের সমাধি ও সোমপুর মহাবিহার এবং আরেকদিকে প্রায় একই দূরত্বে পালরাজা দেবপালের সমাধি, পালদের জয়স্কন্ধাবার ও রাজধানী রামাবতী, মাহী সন্তোষ ও জগদ্দল মহাবিহার। সুতরাং এত সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সন্নিকটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই বাদাল স্তম্ভ স্থাপিত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। 

আরেকটি বিষয়, ২৭ নং শ্লোকে গরুড় স্তম্ভ স্থাপনের কারণটি বোঝা যায়। অন্যের সমৃদ্ধি ও খ্যাতি যাদের চক্ষুশূল, তাদেরকে ফণী বা সাপের সাথে তুলনা করা হয়েছে। তন্ত্রে যশ-খ্যাতিকে শ্বেতবর্ণ বলা হয়, আবার গরুড়ের ধ্যানে এঁকে শ্বেতবর্ণ বলা হয়েছে। গরুড় যেহেতু নাগদের প্রধান শত্রু, তাই প্রশস্তি লিপির উপরে যশোরূপ গরুড় মূর্তি স্থাপন করে সেই ঈর্ষান্বিত শত্রুদের তীব্র ভ্রুকুটি করা হয়েছে। বাংলায় তন্ত্রের প্রভাবের এটি একটি প্রচ্ছন্ন উদাহরণ।

সব মিলিয়ে, বাদাল স্তম্ভের গুরুত্ব বাংলার ইতিহাসে অপরিসীম, কত কিছুর সাক্ষ্য এ শিলালেখ।

কেদারমিশ্র কর্তৃক মঙ্গলময় বারি প্রদান থেকেই এ জায়গার নাম মঙ্গলবারি > মঙ্গলবাড়ি হয়েছে। আজো এ মন্দির ও স্তম্ভ ঘিরে প্রতি বছর বৈশাখে মেলা ও পূজার্চনা আয়োজন হয় আজো। কেদারমিশ্র, তথা বাঙালির ঐতিহ্য এভাবেই শতাব্দীর পর শতাব্দী বয়ে চলেছে নিরবধি। 



একটি বিষয় খুব চোখে ঠেকলো, তা হল নানাভাবে এরূপ অমূল্য স্থাপনার ক্ষতি সাধন। ইট-পাথরের টুকরো দিয়ে ঘঁষে স্তম্ভটির গায়ে নাম খোদাই করেছে অসচেতন জনগণ, লিখেছে প্রেমকথা। কেউ কেউ আবার দল বেঁধে স্তম্ভটিকে ধাক্কা দিয়ে নড়ানোর চেষ্টা করতে দেখলাম। নিষেধ করলে শোনে না। সমগ্র বাংলায় এত বড় শিলালেখ খুব কমই রয়েছে, অথচ কি এক বিড়ম্বনায় রয়েছে এটি। সরকারি কোন পাহারা চোখে পড়লো না। এরপর আবার মাদকাসক্ত বখাটেদের আড্ডা বসে পাশেই, যেহেতু জায়গাটি নিরিবিলি। একা যাওয়াটা একটু বিপজ্জনক। সামগ্রিকভাবে উদাসীনতা ও অবহেলার ছাপ বড় প্রকট। এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ একটু সুনজর দিবেন বলে আশা করি।

তথ্যঋণ:

১. গৌড়লেখমালা, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

২. উত্তরবঙ্গের প্রত্ন-সম্পদ, শরৎকুমার রায়

৩. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন, ধামইরহাট উপজেলা

৪. Pāla Kings in the Badal Praśasti — A Stock-Taking", S.C. Bhattacharya, Journal of Ancient Indian History, Vol. XXIV, 2007-08

৫. বৃহৎ তন্ত্রসার

Comments

Popular posts from this blog

জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

হারিয়ে যাওয়া রামাবতী নগরী: কিছু কথা