জগদ্দল মহাবিহার, নওগাঁ (১ম পর্ব)



বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের চার শতকব্যাপী গৌরবময় রাজত্বকালে তাদের বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিভিন্ন রাজারা অসংখ্য বৌদ্ধ মঠ, মন্দির ও স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। রাজা ধর্মপাল কমপক্ষে ৫০টি স্বয়ংসম্পূর্ণ বৃহদায়তন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন বলে মনে করা হয়। পাল রাজাদের নির্মিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মগধের বিশালায়তন বিক্রমশীলা মহাবিহার, বিক্রমপুরের বিক্রমপুরী বিহার এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের সোমপুর মহাবিহার ও জগদ্দল মহাবিহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


জগদ্দল মহাবিহার নওগাঁ জেলা সদর হতে প্রায় ৬৫ কিঃ মিঃ উত্তরে ধামইরহাট উপজেলার জগদল গ্রামে অবস্থিত। বরেন্দ্র অঞ্চলের ৯১৭ বছরের প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের ব্যতিক্রম ধর্মী কিছু সংযোজন রয়েছে এই জগদ্দল মহাবিহারে।






একাদশ শতকে বিদ্রোহী বঙ্গাল সৈন্য কর্তৃক পাহাড়পুর (সোমপুর) বিহার আক্রান্ত ও অগ্নিদগ্ধ হয়। এই বিশৃঙ্খলা এং বর্হিআক্রমণে পাল সাম্রাজের সার্বভৌম ম্লান হয়ে যায়। বরেন্দ্র অঞ্চল কিছু কালের জন্য স্থানীয় কৈবর্ত রাজা দিব্যোক এবং তার ভ্রাতুষ্পুত্র ভীমের শাসনাধীনে চলে যায়। একাদশ শতকের শেষার্ধে ভীমকে পরাজিত করে রামপাল প্রিয় পিতৃভূমি বরেন্দ্র উদ্ধার করেন। তিনি প্রজা সাধারণের আকুন্ঠ ভালবাসা অর্জনের জন্য মালদহের সন্নিকটে রামাবতি নামক রাজধানী এবং এর নিকটবর্তী স্থানে জগদ্দল মহাবিহার প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিহারে খ্যাতনামা বিদগ্ধ পন্ডিতগণ শিক্ষা প্রদান ও গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিভূতিচন্দ্র (একাধারে গ্রন্থাকার, টিকাকার, অনুবাদক এবং সংশোধক, তিনি কিছুদিন নেপালে ও তিব্বতে ছিলেন এবং তিব্বতীয় ভাষায় অনেক বই অনুবাদ করেছিলেন), আচার্য দানশীল (প্রায় ৬০ খানা তন্ত্র গ্রন্থের অনুবাদ করেছিলেন), আচার্য মোক্ষকর গুপ্ত (তর্কভাষা নামক বৌদ্ধ ন্যায়ের উপর তিনি একটি পুথি লিখেছিলেন), শুভাকর গুপ্ত (তিনি রামপালের সমসাময়িক এবং জগদ্দল বিহারের আচার্য ছিলেন)।








২০১৩ সালে বিহারের খননে জগদ্দল বিহারের পশ্চিম বাহুর একটি ভিক্ষু কক্ষ খনন করতে গিয়ে একটি কুলঙ্গির মধ্যে পাওয়া যায় ১৪টি ব্রোঞ্জের বৌদ্ধ মূর্তি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা জগদ্দল বিহারই লোটাস বিহার (পদ্ম মহাবিহার)। ২০১৪ সালের খননে বিহারের উত্তর বাহু খননে বেরিয়েছে পোড়া মাটির টেরাকোটা, যা বিহারের দেয়ালে সারিবদ্ধভাবে লাগানো রয়েছে। বিহারে এ পর্যন্ত খননে বিরিয়ে এসেছে ৩৩টি ভিক্ষু কক্ষ। প্রতিটি কক্ষই বৌদ্ধ মূর্তি রাখার জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল । পাওয়া গেছে বিহারের পূর্বমুখী প্রধান প্রবেশদ্বার এবং ৮ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৮ মিটার প্রস্থের হলঘর, যেখানে আগতরা অপেক্ষা করত বিহারে প্রবেশের অনুমতির জন্য। এ হল ঘরে পাওয়া গেছে ০৪ টি গ্রানাইট পাথরের পিলার যা ইতোপূর্বে বাংলাদেশের কোন বৌদ্ধ বিহারে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে বিহারের ছাদের ভগ্নাংশ যার পুরুত্ব ৬০ সেমি।


নওগাঁর পাহাড়পুর (সোমপুর) মহাবিহার, কুমিল্লার শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, দিনাজপুরের সীতাকোট বিহারসহ দেশের কোন বিহারে ছাদের ভগ্নাংশ পাওয়া যায়নি। এতে করে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের ছাদের স্বরুপ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া গেছে, যা প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ ও স্থপদিদের গবেষণার দ্বার উন্মোচন করবে। এ বিহারে ব্যবহ্নত ইটগুলি পাথর দিয়ে ঘষে মসৃণ করা হয়েছে। বিহারের বহিঃদেয়ালে চুন-বালির মিশ্রণে কারুকার্যে সাদা রং-এর লতা-পাতা, ফুল ও জীবজন্তুর অলংকার ছিল যার নমুনা পাওয়া যায় দ্বাদশ শতকের বিখ্যাত কবি সন্ধ্যাকর নন্দী কর্তৃক সংস্কৃত ভাষায় রচিত 'রামচরিতম' গ্রন্থে।






জগদ্দল পদ্ম মহাবিহারের পার্শ্ববর্তি ‘‘জগৎনগর বা ‘‘জগতের বিখ্যাত নগর’’ এ পাল সম্রাট রামপালের হারিয়ে যাওয়া সেই ‘‘রামাবতী’’ নগরী রয়েছে বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা ব্যাপক অনুসন্ধান, উৎখনন ও গবেষণার মাধ্যমে পাল সম্রাট রামপালের রাজধানী রামাবতীর সন্ধান মিলে যেতে পারে এ জগদ্দল মহাবিহারে।


প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা সেই রামাবতি নগর এখানেই ছিল। কেননা কাছেই রয়েছে আমইর নামে একটি জনপদ। ভৌগলিক অবস্থান, ভবন-অট্রালিকার ধ্বংসাবশেষ ও নামের সঙ্গে কিছুটা মিল থাকায় আড়ানগর, লক্ষণ পাড়ার সন্নিকটে আমাইড় গ্রামটিই রামাবতি বলে অনুমিত হয়। (এই বিষয়ে আমার লেখা "হারিয়ে যাওয়া রামাবতী নগরী: কিছু কথা" পড়ুন)।







মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এ বিহার সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন তাঁর "প্রাচীন বাংলার গৌরব" বইতে। মহামহোপাধ্যায় লিখেছেন:

রাইট সাহেব নেপাল হইতে কতকগুলি পুঁথি কুড়াইয়া লইয়া গিয়া কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিকে দেন। তাহার মধ্যে শান্তিদেবের শিক্ষাসমুচ্চয় নামে একখানি পুঁথি থাকে। পুঁথিখানি কাগজের হাতের লেখা, অধিকাংশই বাংলা। বেলডল সাহেব যখন এই পুঁথিগুলির ক্যাটালগ করেন তখন তিনি বলেন যে, এ পুঁথিখানি খ্রীস্টের জন্মের চৌদ্দশ বা পনেরোশ বছর পরে লেখা। তাহার পর তিনি যখন উহা ছাপান, তখন তিনি ভূমিকায় লিখেন, “না, আর একশ বছর আগাইয়া যাইতে পারে, কাগজ কি এর চেয়েও পুরানো হবে?” বেন্‌ডল সাহেব একজন বড় লোক। তাঁহার সহিত আমার সদ্ভাব ছিল। তিনি ও আমি দুই জনে একবার নেপাল গিয়াছিলাম। তথাপি এ জায়গায় আমি তাঁহার সহিত একমত হইতে পারি না। আমি নেপালে এর চেয়েও পুরানো কাগজের পুঁথি দেখিয়াছি এবং দুই-একখানি আনাইয়াছি। সুতরাং কাগজ বলিয়া যদি পুঁথিখানি নূতন হয়, তাহ হইলে আমি তাহাতে রাজী নই। ডা: হার্নলি সম্প্রতি দেখাইছেন যে, অনেক পূর্বে নেপালে ‘কায়গদ’ ছিল। ‘কায়গদ’ শব্দটি চীনের। আমরা কাগজ পরে পাইয়াছি, কেননা আমরা উহা সরাসরি চীন হইতে পাই নাই, মূসলমানদের হাত হইতে পাইয়াছি, মুসলমানেরা চীন হইতেই পাইয়াছিল। মুসলমানেরা কায়গদ শব্দটিকে কাগজ করিয়া তুলিয়াছে।

পুঁথিখানির শেষে লেখা আছে – দেয় ধর্মোয়ং প্রবরমহাযানযায়িনো জাগদ্দলপণ্ডিত বিভূতিচন্দ্রস্য ইত্যাদি।

বেন্‌ডল সাহেব বলিয়াছেন, “মহাযানপন্থী জগদ্দল পণ্ডিত বিভূতিচন্দ্র কে আমি জানি না।” ১৯০৭ সালে আমি আবার নেপালে গিয়া কয়েকখানি পুথিতে জগদ্দল মহাবিহারের নাম পাই; কিন্তু আমিও তখন সে মহাবিহার কোথায়, কি বৃত্তান্ত, জানিতাম না। সেই বারে আমি বিভূতিচন্দ্রের নাম পাই। তিনি ‘অমৃতকর্ণিকা’ নামে ‘নামসংগীতি’র একখানি টীকা করেন, ঐ টীকা কালচক্রযানের মতে লিখিত হয়।

তাহার পর রামচরিত কাব্য ছাপাইবার সময় জানিতে পারি, রামপাল রামাবতী নামে যে নগর বসান ‘জগদ্দল মহাবিহার’ তাহারই কাছে ছিল। উহা গঙ্গা ও করতোয়ার সংগমের উপরেই ছিল। এখন করতোয় গঙ্গায় পড়ে না, পড়ে যমুনায়; গঙ্গাও এক সময় বুড়িগঙ্গা দিয়া যাইত। তাই ভাবিয়ছিলাম, রামপাল নামে মুন্সীগঞ্জে যে এক পুরানো গ্রাম আছে, হয়ত সেই রামাবতী ও জগদ্দল উহারই নিকটে কোথাও হইবে। আমি এ কথা প্রকাশ করার পর, অনেকেই জগদ্দল খুঁজিতেছেন, কেহ মালদহে, কেহ বগুড়ায়; কিন্তু খোঁজ এখনও পাওয়া যায় নাই, পাওয়া কিন্তু নিতান্ত দরকার। কারণ, মগধে যেমন নালন্দা, পেশোয়ারে যেমন কনিষ্ক বিহার, কলম্বোতে যেমন দীপদত্তম বিহার, সেইরূপ বাংলার মহাবিহার জগদ্দল। তাঞ্জুরে কোথাও লেখে উহা বরেন্দ্র ছিল, কোন কোন জায়গায় লেখে বাংলা, কোন কোন জায়গায় লেখে পূর্ব-ভারতে।

যাহা হউক, উহা একটি প্রকাণ্ড বিহার ছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। রামপালই যে ঐ বিহার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, এমন বোধ হয় না। এই বিহারে অনেক বড় বড় ভিক্ষু থাকিতেন, তাঁহাদের মধ্যে বিভূতিচন্দ্ৰই প্রধান। বিভূতিচন্দ্র অনেকগুলি সংস্কৃত বৌদ্ধ গ্রন্থের টীকা-টিপ্পণী লিখিয়াছিলেন। যখন তিব্বত দেশে এই সকল বৌদ্ধগ্রন্থ তর্জমা হইতেছে, তখন তিনি অনেক পুস্তকের তর্জমায় সাহায্য করিয়াছেন।....

মহামহোপাধ্যায়ের এই লেখার অনেক পরে এই মহাবিহার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। সৌভাগ্যবশত এ প্রত্নস্থানটিতে অসংখ্যবার গিয়েছি। সর্বশেষ গতবছর যখন যাই তার কিছুদিন আগেই পুনরায় উৎখনন কাজ পরিচালনা করেছে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক। পাওয়া গেছে অসংখ্য নিদর্শন, যার মধ্যে আছে দুইটি নরকংকাল। প্রাপ্ত অন্যান্য প্রত্ননিদর্শন নিয়ে এখনো কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করেননি কর্তৃপক্ষ।













তথ্যঋণ:

১. প্রাচীন বাংলার গৌরব, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
২. নওগাঁ গেজেটিয়ার
৩. বাংলাপিডিয়া
৪. বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব), নীহাররঞ্জন রায়

স্থিরচিত্রের স্বত্ব: লেখক (মোঃ শাহরিয়ার কবির)। বিনা অনুমতিতে ব্যবহার নিষেধ।

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)