ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৫ম পর্ব)

"মমার সুজস্বীষা" – সৎকর্ম স্মরণীয় (Good deeds are remembrance)। 


সোমপুর মহাবিহারে আবিস্কৃত প্রচুর প্রস্তরমূর্তিগুলির মধ্যে ছবির মূর্তিটি অন্যতম। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে নির্মিত বিষ্ণুমূর্তিটির পাদদেশে উৎকীর্ণ আছে উপরের কথাদুটি – মমার সুজস্বীষা। আবহমান কাল ধরে বরেন্দ্রবাসী, তথা সমগ্র মানবজাতিকে সৎকর্ম/ভালো কাজ করার বার্তা দিয়ে চলেছে বরেন্দ্রের শিল্পীর হাতে গড়া এ শিল্পকর্মটি। শিল্পের ভেতর দিয়ে অতীত ও বর্তমানের সংযোগ স্থাপন করে নির্মাণকারী শিল্পী নিজেও অমর হয়ে রয়েছেন। 

একসময় উত্তরবঙ্গে, বিশেষত বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রস্তরশিল্প যে চরম উৎকর্ষতা লাভ করেছিলো বর্তমান সময়ে তা অবিশ্বাস্য মনে হতো যদি না আজকের জাদুঘরগুলিতে এ অঞ্চলে পাওয়া এত এত পাথরের ভাস্কর্য না দেখা যেতো। পাথরের অপ্রতুলতা সত্বেও কিভাবে বরেন্দ্রে এ শিল্পের বিকাশ ঘটলো এবং বাংলার বাইরে সুদূর বালিতেও তার প্রভাব পৌঁছে গেলো, সেটি যথেষ্ট বিস্ময়কর। বিশেষ করে পাল আমলে শিক্ষা-দীক্ষার পাশাপাশি বরেন্দ্রের শিল্পখ্যাতি উচ্চতর সীমায় পৌঁছায়।

তিব্বতের লামা তারানাথ ভারতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস লিখতে গিয়ে আলোচনা করেছেন বরেন্দ্রের সুসমৃদ্ধ শিল্পকলার কথা। তাঁর কথার চুম্বক অংশ:

During the time of king Devapala and Sri Dharmapala, there lived a highly skilled artist, called Dhiman in the Varendra region. His son was called Bitpalo. These two followed the tradition of the Naga artists and practised various techniques like those of metal-casting, engraving and painting. 

The tradition & the technique of the father. became different from that of the son.

(History of Buddhism in India, Lama Taranath)


উপরের অংশটির কিছুটা সম্প্রসারণ করলে ও বইটির পরের অংশের অর্থভেদ করলে যা জানা যায়, প্রাচীন ভারতে শিল্পকলার যে তিনটি ধারা, দেব-নাগ-যক্ষ প্রচলিত ছিলো, গুপ্তযুগের ক্ষয়ের সাথে সাথে শিল্পধারা তিনটির বিকাশ থেমে যায়।  মগধে বিম্বিসার নামের একজন শিল্পী দেব শিল্পরীতি এবং বরেন্দ্র নিবাসী ধীমান ও তাঁর পুত্র বীতপাল (মতান্তরে বীটপাল) নাগ শিল্পরীতি পুনরুজ্জীবিত করেন। ধর্মপাল ও দেবপালের শাসনামলে এই শিল্পরীতির পুনর্জীবন লাভ যে ঢেউ তুলেছিল তা বরেন্দ্রে মোটেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। সে ঢেউ বরেন্দ্র পেরিয়ে, বঙ্গদেশ পেরিয়ে, নেপাল, তিব্বত, চীন ও অবশেষে বলী ও জাভাদ্বীপে পৌঁছেছিল।  

ধীমান ও বীতপাল আমাদের এই বরেন্দ্রের মানুষ। আমাদের পুন্ড্র-বরেন্দ্রের মানুষগুলি মাঝারি উচ্চতার নাতিউচ্চ নাক, শ্যামবর্ণ ও নিরীহ চেহারার। নিশ্চয়ই এ ভূমির সন্তান ধীমান ও বীতপালও দেখতে একই রকম ছিলো, গায়ের রংটা হয়ত আরেকটু গাঢ়, ওঁরা তো আপনার জন, একই পাড়ার মানুষ। অথচ এখনকার পুন্ড্র-বরেন্দ্রীর আমরা অতীতের সেই শিল্প হারিয়ে এখন চেয়ে দেখি বিদেশী শিল্প, নিজেরা দেউলিয়া। আর এ ভূমির পুত্ররা একদিন শুধু ছেনী-হাতুড়ী দিয়ে, কোন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই পাথর কুঁদে বানিয়েছেন মনোমুগ্ধকর শিল্প। ছবির শিল্পটিও নিশ্চয়ই ধীমান অথবা বীতপাল, নয়ত তাঁদেরই কোন শিষ্যের হাতে তৈরী। কি উন্নত শিল্প, কি বিপুল দক্ষতা! 

বছরখানেক আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম ধীমান ও বীতপালের বংশধরেরা আজো রাজশাহী ও নাটোরে রয়েছে। প্রস্তরশিল্প হারিয়ে তারা এখন মাটির হাঁড়ি বানায়, নাম সাধের হাঁড়ি। মনমাতানো রং ও নকশাকার এসব হাঁড়ির কদর ছিলো কিছু আগেও। কিন্তু এখন এসবের কদর নেই, অনেক কষ্ট করে টিকে আছে শিল্পটি। কিছুদিন পরে ওরা হয়তো অন্য পেশা বেছে নেবে। হারিয়ে যাবে ধীমান ও বীতপালের ধ্বজাধারীরা, থাকবে শুধু প্রস্তরশিল্প নিদর্শনগুলি জাদুঘরের শোকেসে নাহয় ট্রেজারী ঘরের অন্ধকারে তালাবদ্ধ অবস্থায়। 

মমার সুজস্বীষা....

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)