ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৯ম পর্ব)
|| ভাসু বিহার ও বীতাশোক ||
হিউয়েং সাং লিখেছেন পো-শি-পো বিহার অতি জাঁকজমকপূর্ণ ও আলোকোজ্জ্বল। বহু সংখ্যক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শিক্ষার্থী আসতো এ বিহারে ভারতের অন্যান্য রাজ্য, এমনকি ভারতের বাইরের দেশ থেকে।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং বৌদ্ধগ্রন্থ অশোকাবদান থেকে জানা যায়, মহামতি অশোকের সহোদর ভ্রাতার নাম বীতাশোক, মতান্তরে তিষ্য। অশোক যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তিনি অন্যান্য ভাইদের হত্যা করলেও বীতাশোককে জীবিত রেখেছিলেন। প্রাণহরণ না করে অশোক তাঁর ভাই বীতাশোককে বৌদ্ধ ভিক্ষু বানিয়ে পুণ্ড্রনগরের একটি বিহারে পাঠিয়ে দেন। পুণ্ড্রের সে বিহারেই আমৃত্যু থেকে গিয়েছিলেন তিনি।
অশোকাবদান থেকে জানা যায়, পুণ্ড্রের এক নির্গ্রন্থী অধিবাসী একটি চিত্র অঙ্কন করেন যেখানে বু্দ্ধ নির্গ্রন্থ নাতাপুত্রকে নত হয়ে প্রণাম করছে দেখানো হয়। এ খবর অশোকের কাছে পৌঁছালে ক্রুদ্ধ সম্রাট আদেশ করেন পুণ্ড্রের সমস্ত নির্গ্রন্থীদের হত্যা করতে। প্রায় ১৮০০০ নির্গ্রন্থী হত্যা করা হয়। এর কিছুদিন পরে একই রকম চিত্র আঁকানো হয় পাটালিপুত্রে। শাস্তিস্বরূপ যে ব্যক্তি চিত্র এঁকেছিল তাকে সপরিবারে পুড়িয়ে মারা হয়। সম্রাট অশোক ঘোষণা দেন যারা নির্গ্রন্থীর মাথা এনে দিতে পারবে, তাকে পুরস্কৃত করা হবে। অশোকাবদান পরিস্থিতির সাক্ষ্য দিচ্ছে এভাবে:
"দৃষ্টা চ রাজ্ঞা রুষিতেনাভিহিতম্ পুণ্ড্রবর্ধনে
সর্ব্বে আজীবিকাঃ প্রঘাতয়িব্যাঃ।"
এসব ডামাডোলর মধ্যে পুণ্ড্রের একজন কৃষক বীতাশোককে নির্গ্রন্থী ভেবে হত্যা করে এবং তার কাটা মাথা অশোকের কাছে নিয়ে যায়। এ ঘটনা অশোকের মনে ভীষণ নাড়া দেয়; ফলে তিনি তাঁর আদেশ প্রত্যাহার করে নেন।
নির্গ্রন্থী হত্যার এ কাহিনী ঐতিহাসিক সত্য কিনা সে বিষয়ে তর্ক চলতেই পারে। যাই হোক, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বীতাশোকের বিষয়ে মন্তব্য পড়ে ভাসু বিহারের কথাই সর্বাগ্রে মনে পড়লো। কেননা, ভাসু বিহারই তো পুণ্ড্রের এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত প্রাচীনতম ও সবচেয়ে খ্যাতি সম্পন্ন বিহার। তাহলে তো বীতাশোক এ বিহারে থাকা সম্ভব! আরো সুলুকসন্ধান করলে হয়তো এটি আরো বিস্তারিত জানা সম্ভব।
দিনাবসানের শেষ আলোয় ভাসু বিহারের ছবিটি মনে করিয়ে দেয়, একসময় এখানেও সাঁঝবাতি জ্বলতো দিনশেষে। সহস্র দীপ জ্বলতো, আলো ঝলমল পো-শি-পো বিহারে। মুন্ডিতমস্তক ভিক্ষুদের দল কেন্দ্রীয় মন্দির প্রদক্ষিণ করতো সন্ধ্যাবেলা, ওঁ মনিপদ্ম... অথবা বুদ্ধং শরণং... উচ্চারণ করে। বীতাশোকও মিশে গিয়েছিলেন সেই ভিক্ষুর দলে। ভাসু বিহারই হয়তো তাঁর শেষ জীবনের স্মৃতিবাহী। পুণ্ড্রের লুপ্ত গৌরবের সাথে সে স্মৃতিও লুপ্ত। হতভাগ্য বীতাশোক!
Comments
Post a Comment