ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১০ ম পর্ব)

|| পুণ্ড্রের পন্ডিত কেশব দীক্ষিত ||

প্রথিতযশা লেখক বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শেষ লেখা "অযাচী সন্ধানে" উপন্যাসটি যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন, নিজের জন্মভূমি মিথিলার এক বিস্মৃত অধ্যায় – প্রবাদপুরুষ অযাচী মিশ্র ও তাঁর পুত্র শঙ্কর মিশ্রের নাম আবিষ্কার করেন লেখক ছোট্ট একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। নিজের শেষ লেখার মধ্য দিয়ে মিথিলার বিখ্যাত পন্ডিত অযাচী মিশ্রের নামটি চিরস্থায়ী করে রেখে গেলেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়।

যাই হোক, এ তো গেল সাহিত্যের কথা। 

আমি যখনই আদিশূর কর্তৃক বরেন্দ্রে পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনয়নের কথা পড়ি, প্রায়শই মনে প্রশ্ন জাগে, পুণ্ড্র-বরেন্দ্র কি তাহলে সত্যিই সুব্রাহ্মণ বঞ্চিত ছিলো? সহসাই একটা ছোট্ট সূত্র পেয়ে গেলাম, যা আমার ধারণাটা বদলে দিলো এবং একটু গর্ববোধও হল। না, পুণ্ড্র-বরেন্দ্রে অনেক সুব্রাহ্মণ ছিলেন, যাঁরা পাণ্ডিত্য দেখিয়ে এ অঞ্চলের গৌরব বাড়িয়েছেন। তাই শুধু শিল্পকলা নয়, শিক্ষা দীক্ষায়ও পুণ্ড্র-বরেন্দ্র মহীয়ান ছিল। পুণ্ড্রের একজন ব্রাহ্মণ তো রীতিমতো ২২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গিয়েছিলেন রাষ্ট্রকূট রাজ্যে অতিথি হয়ে এবং সেখানেই বসতি স্থাপন করেছিলেন রাষ্ট্রকূট রাজার দান করা গ্রামে। উদাসী পুণ্ড্র সে কথা একদম ভুলে গিয়েছে – মনে রাখেনি তার সুপুত্রকে।


পুণ্ড্রের সে ব্রাহ্মণ ছিলেন পন্ডিত কেশব দীক্ষিত, পিতা সুপন্ডিত ও সুকবি দামোদর ভট্ট, নিবাস পুন্ড্রনগর। 

"জীবনীকোষ (২য় খন্ড)" থেকে খুবই সামান্য তথ্য পাওয়া যায় কেশব দীক্ষিত সম্পর্কে: 

"সঙ্গলী তাম্রশাসন পাঠে অবগত হওয়া যায় যে, ৯৩৩ খ্ৰী: অব্দে গৌড়ের পুণ্ড্রবর্ধন নগর হইতে আগত, বেদাধ্যায়ী কেশব দীক্ষিত নামক এক ব্রাহ্মণকে রাষ্ট্রকূটবংশীয় চতুর্থ গোবিন্দ এক খানি গ্রাম দান করিয়াছিলেন । পুণ্ডবৰ্দ্ধন বর্তমান উত্তর বঙ্গ । কেশবের পিতাও একজন বিশেষ বেদজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন।"

রাষ্ট্রকূট রাজা চতুর্থ গোবিন্দ খুব অল্প সময় রাজত্ব করেছিলেন বলে জানা যায়। তিনি পুণ্ড্রের কেশব দীক্ষিতকে তাঁর রাজ্যে আনয়ন করেন এবং বর্তমান মহারাষ্ট্রের সঙ্গলী জেলায় একটি গ্রাম দান করে সেখানে বাস করিয়েছিলেন। 

এ কথাটুকু সঙ্গলী তাম্রশাসন থেকে জানা যায়। এর বেশি তথ্য কোথাও নেই - এমনকি সঙ্গলী তাম্রশাসনের সম্পূর্ণ লেখটিও কোথাও পেলাম না। তবে মনে আক্ষেপ নেই এ কথা ভেবে যে, পুণ্ড্র তথা বাংলার সন্তান কেশব দীক্ষিত নিশ্চয় অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখিয়েই রাষ্ট্রকূটরাজের নিকট সম্মানিত হয়েছিলেন। তিনি আমাদের আরেকটি হারানো গর্বের ধন। 


আমার দৌড় এটুকুই। ইতিহাসের পন্ডিত ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের কেউ যদি আগ্রহী হয়ে সঙ্গলীতে সুলুকসন্ধান করেন, হয়তো কেশব দীক্ষিতের বংশলতিকার সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন। ফলে আমরাও জানতে পারবো বাংলার বিস্মৃত সন্তান কেশব দীক্ষিত সম্পর্কে। যেদিন জানতে পারবো, বাঙালি হিসেবে সেদিন মাথাটা একটু উঁচু করাটা কি খুবই দোষের হবে? আমার উত্তর - না।

তথ্যঋণ:

১. জীবনীকোষ (ভারতীয় ঐতিহাসিক) ২য় খন্ড, শ্রী শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার

২. Migrant Brahmanas in Norther India, Swati Datta, Motilala Banarasidass, 1989

৩. পুণ্ড্রবর্ধন, লেখক অজ্ঞাত, কমল চৌধুরী সম্পাদিত "উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও সংস্কৃতি" বইতে সংগৃহীত ও প্রকাশিত

|| পোস্টে ব্যবহৃত ছবি দুটি পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়) এর সীমানা প্রাচীরের একটি অংশ। নিঃসন্দেহে প্রাচীরের ছবিদুটি যেমন প্রাচীন পৌণ্ড্ররাজ্যের শৌর্য-বীর্যের বার্তাবহ; তেমনি কেশব দীক্ষিত প্রমুখ পন্ডিতবর্গ পুণ্ড্রের উৎকৃষ্ট জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা ব্যবস্থার নিখাদ সাক্ষ্য ||

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)