ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১১ তম পর্ব)

|| পুঁটি হারার কথা ||

"চিরদিনই আমার গল্প শুনতে ভাল লাগে। আর ভাল লাগে এইরকম পড়ন্ত বনেদি বাড়ির পরিবেশ। এসব বাড়ির প্রতিটি ইঁটে, কার্নিশে বটগাছের চারায়, বারান্দার বাঁকে বাঁকে পুরনো দিনের গল্প মিশে আছে। কাদের যেন সব ফিসফাস কানাকানি, হঠাৎ আধো অন্ধকারে কে যেন কোথায় হেসে উঠল, মিলিয়ে আসা ধূপের গন্ধ পাক খায় আনাচে কানাচে।..." 

– অলাতচক্র, তারাদাস বন্দোপাধ্যায়



আজকে একটি ক্ষুদ্র ও অখ্যাত স্থানীয় জমিদারের কথা বলবো। আমার নিজের জেলা শহর জয়পুরহাট থেকে অনতিদূরে এক অখ্যাত স্থানীয় জমিদার ছিলেন – পুঁটিহারা জমিদার। তাঁর প্রকৃত নামটি আর জানা যায় না। তবে তাঁর বাড়ির ভগ্নস্তূপ হারাবতী/শ্রী নদীর ধারে আজো চোখে পড়ে। ওটুকুই জমিদার মশাইয়ের অস্তিত্বের প্রমাণ। আর তাঁর জীবনের করুণ একটি গল্প এখনো স্থানীয় বয়োবৃদ্ধদের মুখে মুখে প্রচলিত আছে। 

গল্পটি জমিদার মশাইয়ের "পুঁটিহারা" নামকরণের সার্থকতা হিসেবেও বিবেচনা করতে পারেন। গল্পটি এরকম:

১৯৪৭ এর দেশভাগের অনেকটা আগে জমিদার বাড়ির দূর্গা পূজার গল্প এটি। প্রতি বছরের মতো জমিদারবাবু তাঁর রায়তদের সাথে নিয়ে সাড়ম্বরে আয়োজন করেছেন নিজের বাড়ির মন্ডপে দূর্গোৎসবের। আয়োজনের কোন কমতি নেই, চারিদিকে আনন্দের হিল্লোল। সেবারের পূজায় অষ্টমীর দিন জমিদারের ৪/৫ বছরের একমাত্র কন্যা, আদুরে নাম পুঁটি, শখ করে লালপেড়ে শাড়ি পড়েছে।  সবার মনে এ নিয়ে কৌতুক খেলা করছে। আনন্দের হাট বসেছে দূর্গা পূজা ও মিষ্টি মেয়ে পুঁটিকে নিয়ে।

সন্ধি পূজা সমাগত। বিশেষ মুহূর্তে সবাই ব্যস্ত হয়ে।পড়লো। সবার বেখেয়ালে পুঁটি খেলার ছলে পুকুর ঘাটে চলে গেল। হয়তো কিছু আনতে পুকুর ঘাটে উবু হতেই টাল সামলাতে না পেরে ঝুপ করে পড়ে গেলো। সবার অলক্ষ্যে ডুবে মরে গেলো পুঁটি। 

সন্ধি পূজার শেষে সবার খেয়াল হলো পুঁটি নেই। আশেপাশে ও বাড়ির কোথাও নেই। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ পড়ে গেলো। অনেক খুঁজে অবশেষে পুকুরে পাওয়া গেলো ছোট্ট পুঁটিকে। শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলো সব আনন্দ উৎসব। 

দশমীর রাত্রে শোকার্ত জমিদার স্বপ্নে দেখলেন পূজার দূর্গা প্রতিমাকে। কিন্তু একি! প্রতিমার মুখে লাল কাপড়ের একটা টুকরো বেড়িয়ে আছে! জমিদার মশাইয়ের চিনতে ভুল হলো না, এটি তাঁর পুঁটির শাড়ির আঁচল। কতো শখের শাড়ি! তবে কি পুঁটিকে তাঁর আরাধ্যা কাছে টেনে নিলেন?

নিঃসন্তান জমিদার আর টিকতে পারেননি শূণ্য বাড়িতে। তাঁর পুঁটি যে হারিয়ে গেছে, সংসার-হাট ভেঙে গেছে। সে-ই থেকে জমিদার বাবুর জমিদারির নাম পুঁটিহারা। অল্পদিন পর জমিদার সব কিছু রেখে পাড়ি জমালেন কলকাতায়। আর ফিরলেন না। পড়ে রইল সব কিছু – শূণ্য বাড়ি, শূণ্য মন্দির, শূণ্য পুকুর ঘাট। এখনো জমিদার বাড়ির কিছু ইট-পাথরের স্তুপ রয়ে গেছে হারাবতী নদীর ধারে, আর রয়ে গেছে পুঁটির হারিয়ে যাওয়া গল্পখানি। সে গল্প শুধুই হারানোর, এক পিতার হাহাকার।

পুঁটিহারা জমিদার বাড়ির ছবি আমার কাছে নেই। ছবিটি বালিয়াটি জমিদার বাড়ির একটি অংশ। সব পুরনো বাড়ির কোণায় কোণায়, ইটের দেয়ালে, ভাঙ্গা বারান্দায় লুকোনো আছে কত শত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার কথা। তার হিসেব কে-ই বা রাখে!

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)