ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১২ তম পর্ব)

|| বলিহার জমিদারবাড়ি ও একটি নরবলি ||

অমাবস্যার রাতে নরবলি! এটা তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প নয়, একটি সত্য ঘটনা - একটি জমিদার বাবু ও একটি স্বর্ণকার পরিবারের কথা – সর্বোপরি একটা সত্যিকারের নরবলির কথা। 

চোখের সামনে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করার মতো করে বুঝতে চাইলে, ইংরেজিতে যাকে Visualize বলে, করতে চাইলে একটি অমাবস্যার তমসাচ্ছন্ন রাতে ফিরে যেতে হবে আপনাকে। তবে বিশ/তিরিশ বছর পিছনে গেলে হবে না, আপনাকে পেছাতে হবে প্রায় ১৫০ বছর, অর্থাৎ ১৮৭০/৭১ সালে যেতে হবে আমার সাথে। 

ঘটনার স্থান আজকের বলিহার জমিদারবাড়ি, বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় যার অবস্থান। আজকের সময় আপনি জমিদারবাড়ির যত্রতত্র ঘুরতে পারেন, ঝকঝকে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিতে পারেন। তাই বলে ১৮৭০ সালে ফেরত গিয়ে আপনি ও আমি সাধারণ নাগরিক জুতা পায়ে এ বাড়িতে কিন্তু ঢুকবো না। আরে মশাই, জুতা পায়ে জমিদারবাড়ি ঢুকতে গেলে পেয়াদারা ঠেঙিয়ে ঠ্যাং ভেঙে দেবে। তাই জুতা খুলে আস্তে ধীরে চলুন। একে তো গভীর রাত, তার ওপর আবার অমাবস্যার পূর্ণ তিথি। আকাশে তারার দেখা নেই, তাই অন্ধকার ক্রমেই চুইয়ে পড়ছে গায়ে। দূরে দূরে শিবার দলের ডাক বুকটা গুড়গুড় করে কেঁপে তুলছে। সমস্ত পরিবেশ থমথম করছে, গাছেরাও যেনো ফিসফিস কথা বলছে ভয়ে ভয়ে। 


আমাদের যেতে হবে বলিহারের জমিদার মশাইয়ের রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে। অমাবস্যায় পূজা হবে আজকে। তাই তো মন্দিরে প্রদীপ জ্বলছে। কয়েকটি মানুষের ছায়ার মতো নড়াচড়া নজরে আসবে দূর থেকে। বাইরে মৃদু আলোর আভা। মন্দিরের সম্মুখের একফালি চাতালটুকুর কিঞ্চিৎ আলো আশেপাশের পরিবেশে আরো অন্ধকার বাড়িয়ে তুলেছে। চাতালের বাইরে হাত বাড়ালেই যেনো অন্ধকার হাতটা টুপ করে গ্রাস করবে। মধ্যরাতের পূজা, কিন্তু প্রজারা কোথায়? বাড়ির নারীরা, জমিদার গৃহিনীই বা নেই কেন? কেবল কয়েকটি বাজনাদার, পুরোহিত মশাই ও স্বয়ং জমিদার মশাই ছাড়া এখন কাউকে দেখতে পাবেন না। দুজন জোগাড়িকে দিয়ে সব কিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে বিদায় দিয়েছেন জমিদারবাবু। আর একজন অবশ্য আছে - বলির খাঁড়া হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে – জমিদারবাবুর বিশ্বস্ত সবাই। আজ বিশেষ পূজা, তান্ত্রিক জমিদারবাবু দেবী রাজরাজেশ্বরী দেবীর বিশেষ পূজা করবেন আজকের বিশেষ তিথিতে, তাই অন্য কারুর থাকার অনুমতি নেই, বাড়িরও কেউ নয় । 

কালিকা পুরাণ মতে, ছাগ, শরভ ও মনুষ্য বলিকে যথাক্রমে বলা হয় বলি, মহাবলি ও 'অতিবলি'; অতিবলির দ্বারা দেবী সহস্র বছর তৃপ্ত হন এবং বলিকৃত মানুষ সম্পূর্ণ নিষ্পাপ হয়ে গণদের অধিপতি হয়ে দেবীর সৎকারের পাত্র হয়। তান্ত্রিক জমিদারবাবু তাই অতি সংগোপনে বহু বছরের ইপ্সিত পূজা করার আয়োজন করেছেন। পূজার সমস্ত কাজ সুচারু রূপে শেষ হতে চলেছে। তবু জমিদারবাবু চিন্তিত হয়ে বারবার মন্দিরের চাতালের দিকে দেখছেন। তাঁর অকালকুষ্মাণ্ড একান্ত ভৃত্য বলির মানুষকে নিয়ে এখনো আসছে না কেন? সে-ই সন্ধ্যার সময় বেরিয়েছে, এখনো আসে না কেন? সমস্ত পরিকল্পনা কি ভণ্ডুল হবে নাকি? 


জমিদারবাবুর ভাগ্য অবশ্য খুব সুপ্রসন্ন। একটু পরেই নতুন কাপড় পরে মুখে হাসি নিয়ে বলির মানুষটি হাজির। সব ঠিক আছে তাহলে? 

আপনি বলির জন্য অপেক্ষারত পাঁঠা দেখেছেন কখনো? প্রায়ই প্রাণীটি কেমন করে জানি কিছু আঁচ করতে পারে, তাই ভয়াল চোখে চারিদিকে তাকায়, কখনো চোখের কোল বেয়ে জলের রেখা দেখা যায়। তবে একবারই দেখেছিলাম পাঁঠাটি সামনে রাখা ঘাস চিবিয়েই চলেছে, কোনদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই। এই বলির মানুষটিও শেষোক্ত পাঁঠার মতো। কেমন জানি ভৃত্যটির সাথে খেলার মেজাজে মজে আছে, পূজার জায়গায় এসে একটু অবাক হয়েছে বটে। ভৃত্যটি তাকে বললো যে পূজা দেখে অনেক সন্দেশ খেয়ে বাড়ি যেতে। লোকটি খুশি বললো, ও এজন্যই বুঝি জমিদারবাবু আমাকে নতুন কাপড় দিয়েছেন। বাহ বাহ! ভৃত্যটি মুচকি হেসে মাথা নাড়ে।

পূজা এগিয়ে চলে, রাত আরো গভীর, আরো থমথমে হয়ে ওঠে। শিবার দল বুকে কাঁপ ধরিয়ে দিচ্ছে হঠাৎ ডেকে উঠে। ঝিঁঝিরাও কোথায় পালালো?

বলির সময় সমাগত। জমিদারবাবুর ইঙ্গিতে ভৃত্যটি মানুষটিকে বললো দেবীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে। প্রণাম শেষ হলে বলে, আজকে তো বিশেষ পূজা, বিশেষ প্রণাম করতে হয়। দেবী তোকে অনেক সন্দেশ দিবেন। লোকটি তো মহাখুশি। বিশেষ প্রণামটি কি! চতুর ভৃত্য সামনের হাঁড়িকাঠ দেখিয়ে বললো আমি তো ওখানে মাথা রেখে প্রণাম করি, পুরুতমশাইও করেন মাঝে মাঝে। 


কথায় কাজ হল। হাঁড়িকাঠে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে প্রণাম জানাচ্ছে লোকটি। বলির বুক কাঁপানো বাজনা বাজছে আরো জোরে। নিমেষে খাঁড়াটি নেমে এল নিচে। বাজনার জোরও বেড়েই চললো। একটুপরে মৃন্ময় পাত্রে রুধির ও দেবীর থানে একটু আগের হাসিমুখ মানুষটির মাথাটি, তাতে সলতে জ্বলছে। সব সুসম্পন্ন। জমিদারবাবুর মুখ প্রসন্ন, মা রাজেশ্বরী তৃপ্ত হয়েছেন। 

দমবন্ধ করা রাতও ফুরায় একসময়, যদিও এ রাতগুলো অনেক দীর্ঘ মনে হয়। সকাল হয়, সব ভয়াল পর্দা কোথায় পালিয়ে যায়। পাখিরা ডাকে। সবকিছুতে শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় ঠাণ্ডা বাতাস।

শান্তির পরশ ছুঁয়ে যায়নি কেবল এখানকার স্বর্ণকার মশাইয়ের বিধবা মায়ের মনে। ভোর না হতেই বেড়িয়ে পড়েছেন মা তাঁর বড় ছেলেকে খুঁজতে। দুই ছেলের মধ্যে বড়টিকে নিয়েই তাঁর যত চিন্তা। সুদর্শন যুবক ছেলেটি মাথায় বেড়ে উঠলেও বুদ্ধিতে বাড়েনি, একদম হাবাগোবা। যে বয়সে মানুষ কামাই রোজগার করে, সে বয়সে এসেও সে সারাদিন টোঁ টোঁ করে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায় আর সন্ধ্যায় যেখানে খোল করতাল সেখানে হাজির। ডাকলেও আসবে না। ঐ যে, কীর্তন ভালোবাসে আর ভালোবাসে সন্দেশ ভোগ - সন্দেশ তার সবচেয়ে পছন্দের খাবার। কাল রাতেও গিয়েছিল জমিদারের ভৃত্যটির সাথে পাশের গ্রামে কীর্তন শুনতে। সকালে উঠে দেখে ছেলে বাড়ি আসেনি। এমন তো হয় না!

জমিদারবাবুর ভৃত্য তো রীতিমতো অবাক। কাল তো একসাথেই ফিরেছি, তারপর তো ভৃত্য ছিল মন্দিরে সারারাত পূজার কাজে। সে তো কিছু জানে না!

সারাটা গ্রাম খুঁজেও ছেলেটি নেই। কয়েকদিন পরে জমিদারবাড়ির এক বাজনাদার রাতের বেলা স্বর্ণকারের বাড়ি এলো, মনে হল খুব গোপনে এসেছে। স্বর্ণকার ও তার মাকে গোপনে বললো সবকিছু, হয়তো মায়ের কষ্ট দেখে বিবেকে নাড়া দিয়েছে। প্রতাপশালী জমিদারবাবু যেন কিছু না জানতে পারে, তাহলেই সর্বনাশ! দয়ার লেশ নেই জমিদারের মনে।

মুখে বালিশ গুঁজে কাঁদলো মা, চোখের জল কেউ যেন না দেখে, কান্নার শব্দ যেনো কেউ না শুনতে পায়। মনের মধ্যে কষ্ট গুমরে ওঠে, কাউকে কিছু বলেন না।

মায়ের মন বলে কথা। এক ছেলে গিয়েছে, আরেকটি হারাতে রাজী নয়। এ গ্রামে তাঁর বড় ছেলে হারিয়ে গিয়েছে, রক্ষক নিজেই ভক্ষক, ছোট ছেলেকে হারালে বংশ নির্বংশ হবে। এখানে আর নয়। কাউকে কিছু জানানো যাবে না, তাহলেই সর্বনাশ। জলে থেকে কুমিরকে ঘাঁটানো কার সাধ্য। পড়ে রইলো সব জমিজিরাত, বাড়ি, দোকান পাট। দোকানের স্বর্ণকয়টি গলিয়ে নিয়ে গভীর রাতে বেরিয়ে পড়ল মা ও ছেলে। যেতে হবে অনেক দূর। জমিদারের নাগালের বাইরে। সেই বলিহার থেকে বহু পথ পাড়ি দিয়ে এলেন রাজা বিরাট গ্রামে। বসতি গড়লেন অন্য জমিদারের এলাকায়। সাধের বলিহার গ্রামে আর যান নি তাঁরা। 

দেড়শ বছর কেটে গিয়েছে। বলিহার জমিদার আর নেই, ১৯৪৭ এ চলে গেলেন সবাই ভারতে, আর আসেননি। জমিদার বাড়ি এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। একসময় যেখানে কেউ জুতা পায়ে, ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ির সিংহদুয়ারের সামনে দিয়ে যেতে পারতো না; জুতা ও ছাতা বগলে নিয়ে মাথা হেঁট করে দরজার সামনের রাস্তা পার হতে হতো, সে জমিদারবাড়িতে কিছু আগে বসতো স্কুল। এখন সাধারণ মানুষের দল যায় ঘুরতে। কোথায় সে দম্ভ, কোথায় সে ক্ষমতার দাপট! জমিদারবাড়িগুলো আমাদের এটাও জানিয়ে দেয়। কোন ক্ষমতা, কোন গদী চিরস্থায়ী নয়। এতো দম্ভ কিসের! কান পাতুন নিরবে, আপনিও শুনতে পাবেন।


আর স্বর্ণকারের অধস্তন পঞ্চম পুরুষের বিরাট জুয়েলার্সের দোকানে বসে আমি শুনছি এ করুণ গাঁথা। তাদের ষষ্ঠ পুরুষ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে। এ যেনো "তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে'। বেঁচে থাক এ বংশ আরো দেড়শ বছর। 

এ কোন কল্পকথা নয়। সম্রাট অশোকের অশোকাবদান নয়, কলহনের রাজতরঙ্গিণীও নয়। এ এক সাধারণ পরিবারের আটপৌরে পারিবারিক গল্প, পুরুষানুক্রমে টিকে থাকার কথা, বেদনার কথা, আবার বেঁচে থাকার প্রেরণাও বটে।

তাই বলে, বলিহার জমিদার বংশ শুধু অত্যাচারী, খারাপ তা নয়। সেটি প্রমাণ করাও আমার উদ্দেশ্য নয় – এ উদ্দেশ্য থাকলে এক্ষুনি আমার দিকে অনেকে কামান দাগবেন বিভিন্ন সাইজের – কেউ বলবেন আমি কমিউনিস্ট, জমিদার আমার কাছে শ্রেণীশত্রু, কেউ বলবেন হিন্দু জমিদারের নিন্দে করছি। বিষয়টি মোটেই তা নয়। এ জমিদার পরিবার এ অঞ্চলে অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন বলে জানা যায়, কত শত পুকুর খনন করে প্রজার জলকষ্ট নিবারণ করেছেন, আরো অনেক কিছু করেছেন। ভালো-মন্দ মিলিয়ে আবার, মন্দ-ভালো মিলিয়েও মানুষ। 

তবে বলিহার জমিদারের আরেকটি কথা ইতিহাসের পাতায় রয়ে গেছে। সেটা বলে আজকে শেষ করবো।

পূর্ব ভারতে জরিপ কাজ পরিচালনা করার সময় স্যার বুকানন হ্যামিল্টন ১৮০৭ থেকে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে পাহাড়পুরের বিশাল ঢিবিটি পরিদর্শন করেন এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থাপনা বলে চিহ্নিত করেন। এটিই ছিল পাহাড়পুরে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক পরিদর্শন। এরপর এই প্রত্নস্থল পরিদর্শনে আসেন দিনাজপুরের তৎকালীন কালেক্টরেট ওয়েস্টম্যাকট। তাঁরা উভয়ে এ বিশাল ঢিবি সম্পর্কে রিপোর্ট বিলেতে পেশ করেন। এরই সূত্র ধরে ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই ঐতিহাসিক স্থানটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনের পর এই জমিটি ব্যাপক হারে খনন করার প্রতি তিনি আগ্রহ দেখান। পাহাড়পুর ঢিবিটি বলিহার জমিদারির অন্তর্গত ছিলো। আলেকজান্ডার ক্যানিংহামের এ স্থানে উৎখননের বাধা দেন বলিহার জমিদারমশাই। ফলে খুব সামান্য খনন করেই কাজ বন্ধ করতে হয়। পরবর্তীতে স্যার আলেকজান্ডার ক্যানিংহাম এ নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি করেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির অন্যান্য সদস্যগণ কয়েকবার পাহাড়পুর পরিদর্শন করে এখানে অবিলম্বে যথাযথভাবে উৎখনন, গবেষণা ও সংরক্ষণের বিষয়ে জোর দেন এবং বলিহার জমিদারের অসহযোগিতার জন্য উষ্মা প্রকাশ করেন। অবশেষে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক আইনের আওতায় এই স্থান ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষিত হয়। এরই ফলশ্রুতিতে আমরা বাঙালির ইতিহাসের এক বিরাট অধ্যায়ের পরিচয় পাই – সোমপুর মহাবিহারের অজানা কথা জানতে পারি আমরা।

তথ্যঋণ:

১. কালিকা পুরাণ 

২. পাহাড়পুরের পুরাতন স্তুপ, শ্রীরাম মৈত্রেয়

৩. উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তি, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

ছবিঋণ: এই পোস্টের ছবিগুলো উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া, ছবি তুলেছেন জনাব নাজমুল হুদা (Najmul Huda). 

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)