ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১৩ তম পর্ব)

|| একটি চৌধুরী পরিবারের কথা ||


The Marquis of Cornwallis, Knight of the most noble order of Garter, Governor-General in Council, now notifies of all Zaminders, independent Talookdars, and other actual proprietors of land in the provinces of Bengal, Behar and Orissa, that he has been empowered by the Honourable Court of Directors for the affairs of the East India Company, to declare the Jumma, which has been or may be assessed upon their lands under the regulations, above mentioned, fixed for ever. The Governor-General in the Council accordingly declares to the Zaminders, independent Talookdars and other actual proprietors of land, with or on behalf of whom, a Settlement has been completed, that at the expiration of the term of the settlement, no alternation will be made  in the assessment which they have respectively engaged to pay, but that they, and their heirs and lawful successors will be allowed to hold their estates at such assessment for ever.

(Regulation I of 1793, Art II and III passed on 1st May, 1793.)

১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চ লর্ড কর্ণওয়ালিস উপরের বিজ্ঞপ্তিটি জারী করলেন। সেই সাথে সূচিত হলো বাংলার ইতিহাসের একটি সুদীর্ঘ অধ্যায়। বাংলার সাত অষ্টমাংশ, বিহারের তিন পঞ্চমাংশ, উত্তর পশ্চিম প্রদেশের বেনারস ও অযোধ্যা, কটক ব্যতিত সমগ্র উড়িষ্যা এবং মাদ্রাজের কিছু অংশে জারী হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা। সূচিত হলো এমন একটি যুগের যা পরবর্তী দেড়শ বছরের বেশি স্থায়ী হলো। পাঠান-মুঘলদের দ্বারা যে জমিদারি প্রথার সূচনা, ইংরেজদের হাতে তার যৌবন প্রাপ্তি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হলো সেই যুবক জমিদারির হাতের পাঁচ ও প্যাঁচ। এ দেড়শ বছরের ইতিহাসে নন্দিত–নিন্দিত জমিদারের হাতে কতশত অধ্যায় রচিত হল – রায়তের বঞ্চনা ও কষ্টও আছে, দিনবদলের পালাও আছে। সেসব নিয়ে রবিঠাকুর থেকে শুরু করে বিভূতিভূষণ– তারাশঙ্কর– মানিক সবাই রচনা করলেন অজস্র লেখা – উপন্যাস, নাটক কত কিছু! বাঙালির সাহিত্যে দুটি জিনিসের দেখা মেলে সবচেয়ে বেশি – জমিদার মশাই আর ট্রেন। তবে যাঁরা সাহিত্যপ্রেমী তাঁরা অবশ্যই তারাশঙ্করের মহত্তম সৃষ্টি "কীর্তিহাটের কড়চা" অবশ্যই পড়বেন। জমিদারবংশ নিয়ে এর চেয়ে গভীর লেখা খুব একটা নেই বাংলা সাহিত্যে – প্রায় রিস্ক ছাড়াই কথাটি বললাম। 


বাঙালি তো – ধান ভানতে শিবের গীত গাইলাম একটু, হাজার হলেও জাতিগত স্বভাব। 

এখন আসি ইতিহাসের কথায়। ছবিতে যে ভগ্নস্তুপ হয়ে যাওয়া বিলুপ্ত প্রায় স্থাপনাটি দেখবেন, সেটি একজন স্থানীয় ক্ষুদ্র জমিদার মশাইয়ের। এ প্রত্ননিদর্শনটি আমার নিজের জেলা জয়পুরহাট থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। স্নেহের ছোট ভাই লালন হোসেন ও বন্ধুবর সাজেদুর রহমান সুমন প্রথম আমাকে জানায় এ স্থাপনাটি সম্পর্কে। সরকারী দস্তাবেজে জায়গার নাম জয়-পার্বতীপুর, গ্রামটির বর্তমান নাম লালিপাড়া, মৌজা অবশ্য এখনো জয়-পার্বতীপুর মৌজা। 

সরকারী প্রত্ন অধিদপ্তরের খাতায় নাম না লিখিয়েই আর অন্য কাউকে না জানিয়েই জমিদারবাড়িটি ইতোমধ্যে লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে গেছে। জমিদারবাড়ির পুরনো ইট দিয়ে অনেকে বাড়ির দেওয়াল গেঁথেছে দেখলাম, বাকী সব ভেঙে সমান করে অনেক বাড়িঘর হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় ভাদসা বাজার থেকে এক কিলোমিটার সামনে এগিয়ে প্রধান সড়ক ছেড়ে বামে ৫০০ মিটার মাটির হাঁটা পথে গেলেই পৌঁছে যাবেন এখানে। কাঁচা মাটির রাস্তায় বিছানো ইটগুলিও প্রাচীনকালের, জমিদার বাড়ির। গাছগাছালি ঘেরা মায়াময় গ্রামখানি। 





জমিদার বাড়ির সবটা গেলেও কোনমতে টিকে আছে কাছারিঘরটি এবং তার পেছনে অবস্থিত জমিদারবাড়ির রাধাগোবিন্দ মন্দিরটি। কাছারিঘরের দেয়ালে ঘর তুলে বসবাস করেন এ গ্রামের একমাত্র হিন্দু পরিবার, ব্রাহ্মণ পরিবার, চক্রবর্তী মশাই যজমানি করেন দূর গ্রামগুলিতে। সন্ধ্যার প্রাক্কালে কথা হচ্ছিল তাঁর সাথে। চক্রবর্তী মশাই জানালেন, কাছারিঘরটির ছাদ ধসে পড়ার উপক্রম। তাঁর বাড়ির অন্দরমহলের দেয়ালে কাছারিঘরে ঢোকার একটা দরজা এখনো টিকে আছে, তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন, যাতে কেউ না ঢুকতে পারে আর ছাদ ভেঙে দূর্ঘটনা না ঘটে। কাছারিঘরের বাহিরের দিকের দেয়ালের সৌন্দর্য এখনো মুগ্ধ করার মতো। ফুল পাতার মনোহারী নকশা জমিদার মশাইয়ের রুচির পরিচয় দিচ্ছে। প্রত্নবস্তু হিসেবে এগুলোও নিতান্ত ফেলনা নয়। বাংলার চিরায়ত সম্পদ এসব প্রাচীন নকশাগুলো, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।

জমিদার পরিবারের পদবী ছিল চৌধুরী, সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় এ পরিবারটি ক্ষুদ্র জমিদারি লাভ করে। সে হিসেবে প্রায় ৩০০/৩৫০ বছর আগের জমিদারি। চক্রবর্তী মশায় জমিদার বংশের সর্বশেষ তিন পুরুষের নাম বলতে পারেন। তাঁরা হলেন বিষ্টুপদ চৌধুরী, তাঁর পিতা হরিকিঙ্কর চৌধুরী এবং তস্য পিতা গৌরকিঙ্কর চৌধুরী। চৌধুরী পরিবারটি বৈষ্ণব, বাড়িতে রাধাগোবিন্দ মন্দির, নিত্যসেবা হত। পরিবারটির শেষ পুরুষ বিষ্টুপদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পরে সমস্ত সম্পত্তি বিনিময়ের মাধ্যমে ভারতে চলে যান। হয়তো চৌধুরী পরিবারটির পরের বংশধরেরা ওপার বাংলায় এখনো আছেন। 





জমিদারবাড়ির ইষ্ট দেবতার মন্দিরটি আজ শূন্য। বছর দশেক আগেও মন্দিরে নিত্যপূজা হত, দূর্গা ও কালী পূজাও হতো। এ গ্রামের হিন্দু পরিবারগুলো ভাদসা বাজার ও তার আশেপাশে নতুন বসতিতে চলে গিয়েছে, ফলে এখন আর কোন পূজা হয়না। কোন মতে সন্ধ্যায় ক্বচিৎ কদাচিৎ সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হয়। তবে চক্রবর্তী মশাই আশার কথা শোনালেন। আশেপাশের গ্রামের হিন্দু পরিবার নতুনভাবে মন্দির কমিটি গঠন করে ভাঙা মন্দির সিমেন্ট-বালি দিয়ে সংস্কার করেছে ও চারিদিকে নতুনকরে সীমানা প্রাচীর দিয়েছে। আবারো চালু করার চেষ্টা চলছে। নতুন সংস্কারে যদিও পুরনো স্থাপনা কেমন ছিল তা আর বোঝার উপায় নেই, কিন্তু তা'তেই খুশি তিনি। 


পুরনো অর্চনাহীন মন্দিরে কেমন একটা গা ছমছমে ভাব, উঠান জুড়ে আগাছা আর ঘাস। ঝিমিয়ে আসা পরিবেশ। পুরাতনকে বদলেই নতুনের সূচনা, তাই সামনে এগিয়ে যাই – পুরনোকে চিরতরে বিদায় দেওয়ার আগে কয়েকটা ছবি নিলাম। ওপার বাংলার বিষ্টুপদ চৌধুরীর বংশধর কেউ যদি এ পোস্টটি দেখতে পান, তাহলে তাঁরা যেনো দূর থেকেই প্রণাম জানান তাঁদের বাস্তু লক্ষ্মী, তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটা ও সবশেষে তাঁদের রেখে যাওয়া কুলদেবতাকে। কিছুদিনের মধ্যে কাছারিঘরটিও ভেঙে পড়বে। আর বেশি সময় নেই। সকলি গিয়াছে, শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি....

তথ্যঋণ:

১. বাঙ্গলার জমিদার, শ্রীবামাচরণ মজুমদার

২. ছবি ও বাকী সমস্ত তথ্য ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে আমার নিজের সংগ্রহ। 

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)