ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১৪ তম পর্ব)

|| মোহাম্মদ-ই-শিরান খিলজির সমাধি, মাহী সন্তোষ, নওগাঁ, বাংলাদেশ ||

১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির ক্যাম্প বসল বরেন্দ্রভূমির আরেকটি হারিয়ে যাওয়া নগরী মাহী সন্তোষে। সেবারের দলে ছিলেন অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, কুমার শরৎকুমার রায়, অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল, রমাপ্রসাদ চন্দ ও আরো কয়েকজন ইতিহাসপ্রেমী। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির গাঁইতি ও কোদালের মাধ্যমে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হল বাংলার একটি গৌরবময় অধ্যায়। ইতিহাসের এ পাতাখানি সযত্নে লিখে রেখেছে পাল আমলের গৌরবময় সময় থেকে শুরু করে মুসলিম যুগের ইতিহাসের অনেক ঘটনাবলী।

মাহী সন্তোষে সেবারের উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা ও অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা হচ্ছে মোহাম্মদ-ই-শিরান খিলজির সমাধি।

 

প্রাচীন কবরস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর


বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি একটি অতি প্রাচীন ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পাশে খুঁজে পায় একটি প্রাচীন জঙ্গলাকীর্ণ কবরস্থান, যেখানে অনেকগুলো কবরের মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা একটি কবর সবার নজর কাড়ে। ইতিহাসের নানা তথ্য-উপাত্ত মিলিয়ে এটিকে শিরান খিলজির সমাধি বলে চিহ্নিত করা হয়।


এখন আসি শিরান খিলজি সম্পর্কে। স্বাভাবিক প্রশ্ন, কে এই মোহাম্মদ-ই-শিরান খিলজি?

ইখতিয়ার উদ্দিন বিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির বাংলা ও বিহার অভিযানের একান্ত সহচর ছিলেন মোহাম্মদ-ই-শিরান খিলজি। আফগান যোদ্ধা শিরান ও তাঁর ভাই বখতিয়ারের দলভুক্ত হয়ে ভারতবর্ষে আসেন মূলত ভাগ্যান্বেষণে। নদীয়া আক্রমনের সময় শিরান সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে খিলজি শিবিরে সুনাম অর্জন করেন এবং বখতিয়ারের আস্থাভাজন হন।

বখতিয়ার খিলজি ১২০৪-৫ খ্রিষ্টাব্দে নদীয়া ও লক্ষ্মণাবতী দখলের পরে উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ বরেন্দ্রভূমির কিছু অংশ জয় করেন। তবে বিজিত অঞ্চলের আয়তন বাংলার মোট আয়তনের তুলনায় খুব সামান্য ছিল এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তখনও বাংলার অধিকাংশ অঞ্চলে সেন রাজা ও স্থানীয় স্বাধীন রাজারা শাসন পরিচালনা করছিলেন। বখতিয়ার খিলজি প্রাচীন বাণগড়ের একটি অংশ দেবীকোটে নিজের শাসনকেন্দ্র ও সামরিক ছাউনি স্থাপন করেন। বিজিত অঞ্চলকে কয়েকটি পরগণায় বিভক্ত করে নিজের বিশ্বস্ত সেনানায়কদের আমীর পদে বহাল করেন বখতিয়ার খিলজি। সবগুলি পরগণার নাম ও আমীরগণের নাম এখন আর জানা যায় না। উল্লেখযোগ্য পরগণাগুলি হল কাঙ্গার বা গাঙ্গোর, মসিদা ও সন্তোষ।  বাংলায় বখতিয়ার অধিকৃত অঞ্চলে কাঙ্গার/গাঙ্গোর–মসিদা–সন্তোষ–দেবীকোট এ চারটি পরগণা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং খিলজিদের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে এ চারটি পরগণার নামও জড়িয়ে আছে। উল্লেখ্য, সন্তোষ পরগণায় বর্তমান মাহী সন্তোষ অবস্থিত।





বখতিয়ার খিলজি বাংলায় অভিযান শেষ করে বিজিত অঞ্চলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না করেই তিব্বত অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। দূর্ভাগ্যক্রমে তিব্বত অভিযান ব্যর্থ হয় এবং মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত বখতিয়ার দেবীকোটে ফিরে আসেন। এদিকে খিলজিদের নিজেদের মধ্যে শুরু হয়ে যাওয়া ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্বের জেরে গুপ্ত আততায়ীর ছুরিকাঘাতে অসুস্থ বখতিয়ার প্রাণ হারান। এমন সময় শিরান খিলজি উড়িষ্যা অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন। 

শিরানের অনুপস্থিতিতে আলী মর্দান খিলজি দেবীকোট দখল করেন। এ খবর শুনে শিরান দেবীকোটে ফিরে আসেন এবং আলী মর্দানকে বন্দী করে নিজে অন্যান্য আমীরদের সমর্থনে মসনদে আসীন হন। চতুর আলী মর্দান সুকৌশলে কারাগার থেকে পালিয়ে দিল্লী যান। সেসময় দিল্লীর সিংহাসনে আসীন সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক। আলী মর্দান সুলতানকে বাংলা আক্রমনে প্ররোচিত করতে থাকেন এবং এক সময় সফল হন। দিল্লীর সুলতান অযোধ্যার শাসক কায়মেজ রুমীকে আলী মর্দানের সহায়তার নির্দেশ দেন। ফলে আলী মর্দান ও কায়মেজ রুমীর যৌথ আক্রমণে শিরান খিলজি পরাজিত হন। 

শিরান খিলজি পুনরায় সবাইকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেন আলী মর্দানের বিরুদ্ধে। কিন্তু এ পরাজয়ের ফলে খিলজিদের মধ্যে আবারো রক্তপাতের সূচনা হয়। মসিদা ও সন্তোষের আমীরগণ শিরানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১১৯ জনের একটি সেনাদল নিয়ে শিরান সন্তোষে আক্রমন করেন বিদ্রোহ দমন করতে। কিন্তু বিধি বাম! শিরান ও তাঁর সেনাদল পরাজিত ও নিহত হন। পরে শিরানকে কবর দেওয়া হয় সন্তোষেই। খিলজিদের বাংলা অভিযানের পরের কয়েকটি বছর ইতিহাসে এমনই এক রক্তাক্ত অধ্যায় হিসেবে লিখিত হয়ে রইলো। 

বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি যখন শিরান খিলজির কবরটি খুঁজে পায়, তখন এটি ইট দিয়ে বাঁধানে একটি সমাধি ছিল। সমাধিটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এবং এর দৈর্ঘ্য ১৪ হাত। সমাধির পূর্ব দিকের দেওয়ালে প্রদীপ জ্বালানোর জন্য কুলুঙ্গি ছিল এবং কুলুঙ্গিটির খিলান বিল্বপত্রের মত ত্রিপত্রাকার। এটা সুস্পষ্ট যে, মুসলিম শাসনের শুরুর দিকে হিন্দু স্থাপত্যকলার প্রভাব রয়ে গিয়েছিল; যার ফলে মুসলমানের কবরে বিল্বপত্রের আকারের খিলানযুক্ত দীপদানের কুলুঙ্গি নির্মাণ করা হয়। কবরটির আশেপাশে অনেক মাটির প্রদীপ, একটি লোহার বর্শা ও একটি লোহার তীরের ফলক পাওয়া যায়। এটি সুস্পষ্ট যে, শিরানের সমাধিতে তাঁরই কোন অনুগত দল মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে সম্মান প্রদর্শন করতো। 

তবে এ কবরটি সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বহুল প্রচলিত যে, কবরটিকে "১২০ গাজীর কবর"ও বলা হয়। এ থেকে বুঝা যায়, কবরটিতে কেবল শিরান খিলজি নয়, তাঁর বাকী ১১৯ জন নিহত সৈন্যদেরও এখানে কবর দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, এটি একটি গণকবর এবং শিরানের নীরব সমর্থকরা পরবর্তী কালে শিরান ও তাঁর সেনাদের গাজী (শহীদ) মর্যাদা দিয়ে কবরটি পাকা করে এবং প্রদীপ প্রজ্বলন করতো। আমিও এ মতটিই সমর্থন করি। গণকবর না হলে একজন মানুষের কবর ১৪ হাত লম্বা হওয়ার কথা নয়। অতি উৎসাহী মানুষজন কবরটি সংস্কার করতে গিয়ে এর প্রাচীনত্ব নষ্ট করে ফেলেছে। হাল আমলের টাইলস দিয়ে মুড়ে দিয়ে ইতিহাসের অমূল্য উপাদানকেও কবরে পাঠিয়েছে। এখন দেখলে কবরটি হাল আমলের স্থাপনা বলে মনে হবে। 

শিরান খিলজির কবর বা ১২০ গাজীর কবরে এখন আর প্রদীপ জ্বালানো হয় না। তবে এ কবরের অসাধারণত্ব বিষয়ে একটি প্রবাদ আজো প্রচলিত। সেটি আমি এই কবরস্থানের খাদেমের মুখে শুনি। খাদেম বললেন, কবরটির দৈর্ঘ্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে মাপলে যে পরিমাপ পাবো, পশ্চিম থেকে পূর্বে মাপলে পরিমাপ আলাদা হবে। এটি নাকি এ কবরের একটি বিশেষত্ব। আমি অবশ্য সাহস করে আর কবর মাপতে যাইনি। তবে এটুকু বুঝেছি শিরান খিলজির প্রভাব এখনো মাহী সন্তোষে বিদ্যমান, সেটি তাঁর বীরত্বের জন্যই হোক, আর দলনেতা বখতিয়ার খিলজির প্রতি আমৃত্যু আনুগত্যের জন্যই হোক। ভাগ্যান্বেষণে ভারতে আসা আফগান যুবকটি এভাবেই ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লিখিয়েছেন। 

তথ্যসূত্র:

১. বরেন্দ্র খনন বিবরণ, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)