ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১৫ তম পর্ব)

|| একটি নদীর কথা: তুলসীগঙ্গা নদী ||

কবিগুরুর ছোট নদীর মতো বরেন্দ্রভূমিতে আমার নিজের জেলাতেও একটি ছোট, কিন্তু মিষ্টি নদী আছে।নাম তুলসীগঙ্গা নদী, বেশ রূপসী। কতবার দেখেছি, অথচ এর রূপসজ্জা প্রতিবার বদলে যায়। দু'দিন আগে শ্রাবণ মেঘের ঘনঘটায় দেখলাম আরেকটি মনোহারিণী রূপ। তিলোত্তমা অপ্সরাকে দেখিনি, তবে তুলসীগঙ্গার রূপের পসরা দেখেছি। 






এখন দেখতে শান্তশিষ্ট ছোট নদী মনে হলেও একসময় এ নদীতে চলতো বড় বড় নৌকা, বাণিজ্যিক তরী। সমৃদ্ধ পুণ্ড্রনগর থেকে করতোয়া নদী হয়ে এসব বিশাল নৌকা চলে আসত তুলসীগঙ্গা নদীর তীরে পুণ্ড্রের প্রধান দুটি প্রশাসনিক কেন্দ্রের একটি – পঞ্চনগরীতে। সে পঞ্চনগরীর ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়েছে জয়পুরহাটের পাথরঘাটায় । বিদেশী বণিকেরাও যাতায়াত করতো এ নদীপথে। কারণ, গ্রীকদের বর্ণিত পেন্টাপোলিস তথা পঞ্চনগরী তো এ নদীর তীরে। এসব গৌরবগাঁথা সবই আড়াই/ তিন হাজার বছর আগে রচিত হয়েছিল। পুণ্ড্রের স্বর্ণযুগে সেদিনের এ নগরীর সমৃদ্ধিও ছিল সর্বোচ্চ শিখরে।









গুপ্তযুগে এ বিপুলা নদীর ওপর নির্মিত হয় বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত পাওয়া একমাত্র পাথরের সেতু। কি গরবিনী ছিল তুলসীগঙ্গা সে সময় বুকে সুদৃশ্য পাথরের সেতু নিয়ে। আজো এসব স্মৃতিচিহ্ন আপনি খুঁজে পাবেন তুলসীগঙ্গার দুই তীরে প্রায় ০৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে। প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষে খুঁজে ফিরতে পারেন সে হারানো দিনের কথা। আমি পাথরঘাটা প্রত্নস্থল নিয়ে আগেও দুটি ব্লগ লিখেছিলাম; তাই এ বিষয়ে আর বিস্তারিত কিছু বলছি না।

পাল আমলেও তুলসীগঙ্গা নদীর গুরুত্ব কমেনি। এ নদীর তীরে পাল সম্রাট প্রথম মহীপাল বরেন্দ্রকে সুরক্ষিত করার জন্য স্থাপন করেন জয়স্কন্ধাবার। জায়গাটি মহীপুর নাম নিয়ে আজো সে ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে। এ অঞ্চলে একসময় প্রচলিত ছিল পাল সম্রাট মহীপালের নামে "মহীপালের গীত"। ইতিহাসের একটি সহজপাঠ হলো, প্রায় সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছে নদীকে আশ্রয় করে। নদী ও মানুষের এ সম্পর্ক অনাদিকাল থেকে, এখানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার শালখুড়িয়া বিলাঞ্চলে উৎপত্তি হয়ে এ নদী পাড়ি দিয়েছে ১০০ কিলোমিটার পথ এবং তারপরেই আরেকটি নদী ছোট যমুনায় মিলিত হয়ে অবশেষে প্রাচীন আত্রেয়ী বা আত্রাই নদীতে সাঙ্গ করেছে পথচলা। বড় সর্পিল গতিতে ছুটে চলেছে কত জানা-অজানা ইতিহাসের কথা বুকে নিয়ে। এ বছরে নদী ড্রেজিংয়ের সময় তুলসীগঙ্গায় পাওয়া গিয়েছে বিরাটকার বিষ্ণুমূর্তি এবং বেশ বিরল নবগ্রহ মূর্তি। দু’টিই পাল আমলের শিল্প। এমন অজস্র নিদর্শন রয়েছে তুলসীগঙ্গার বুকে ও তার তীরে।

কালের পরিক্রমায় নদীটি আজ শীর্ণকায়া হয়ে গিয়েছে। ভালো খবর হল, এ বছর ড্রেজিং করে এর পুরনো গতি ফেরানোর একটা চেষ্টা করা হয়েছে। 

তুলসীগঙ্গা নদীকে বরেন্দ্রের হিন্দু সম্প্রদায় শ্রদ্ধার চোখে দেখে এবং এ নদীকেও গঙ্গার আরেকটি রূপ মনে করে। প্রতি বছর দূর্গা পূজার দশমীতে বিসর্জনের আলোক ও বাদ্যে ভরে যায় এ নদীর বুক।

পরিশেষে, যারা মাছ খেতে ভালোবাসেন তাদেরকে বলছি এ নদীর কালবাউশ মাছের স্বাদ কিন্তু অসাধারণ। রুই মাছও কম যায় না। এদিকপানে আসলে খেয়ে দেখবেন। 

তথ্যসূত্র: 

১. আমার পূর্বের লেখা "পঞ্চনগরীর সন্ধানে (১ম ও ২য় পর্ব)

২. নদীর উৎপত্তিস্থল, দৈর্ঘ্য ও মোহনার তথ্য পেয়েছি উইকিপিডিয়া ও সরকারী তথ্য বাতায়ন থেকে

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)