ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১৬ তম পর্ব)

|| একটি নদীর কথা: ছোট যমুনা নদী ||

কিছুদিন আগে সমরেশ বসুর "গঙ্গা" এবং হরিশংকর জলদাসের "জলপুত্র" উপন্যাসদুটি পড়তে গিয়ে একটি বিষয় খেয়াল করলাম, বাংলাকে নদীমাতৃক দেশ বলা হলেও বাংলা সাহিত্যে নদী নিয়ে লেখা উপন্যাসের সংখ্যা খুবই কম, হাতে গোনা যায়। কবিতা ও গান অবশ্য আছে, তবে সুলুকসন্ধান করলে দেখবেন এ সংখ্যাটিও আশানুরূপ নয়। 

বাংলার ইতিহাসচর্চায়ও এর প্রতিফলন সুস্পষ্ট। এদেশের ইতিহাস বর্ণনায় নদীর নামগুলো প্রায়শ রয়েছে স্থান নির্ণয়ের প্রয়োজনে, এর বেশি নয়। আবার গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, করতোয়া নদী নিয়ে যেটুকু আলোচনা আজ পর্যন্ত দেখা যায় সেখানে পৌরাণিক উপাখ্যান বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। অথচ বাংলার ইতিহাসে নদনদীর অবদান গবেষণার যথেষ্ট দাবী রাখে। কতশত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে বাংলার বুকে শিরা-উপশিরার মতো বয়ে চলা জানা-অজানা কতশত নদনদী। আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতায় নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায়ের নিচের কথাগুলোর সাথে আমি একমত:

"বাঙলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাঙলার ছোট-বড় অসংখ্য নদনদী। এই নদনদীগুলিই বাঙলার প্রাণ; ইহারাই বাঙলাকে গড়িয়াছে, বাঙলার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে, এখনও করিতেছে। এই নদনদীগুলিই বাঙলার আশীৰ্বাদ; এবং প্রকৃতির তাড়নায়, মানুষের অবহেলায় কখনও কখনও বোধহয় বাঙলার অভিশাপও।" 

আমি আগের পর্বে বরেন্দ্র অঞ্চলের একটি নদী, তুলসীগঙ্গা নিয়ে লিখেছিলাম। আজকে কথা বলবো আরেকটি নদী নিয়ে, যার নাম "ছোট যমুনা"। আমার নিজের জেলা জয়পুরহাটের উপর দিয়ে বয়ে চলা ছোট যমুনা নদীকে দেখেছি শৈশব থেকেই। এ অঞ্চলের ইতিহাসের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ছোট যমুনার নাম। অনেক ইতিহাসের কথা বুকে নিয়ে কতশত বছর ধরে বরেন্দ্রীর বুক চিরে নদীটি বয়ে চলেছে নিরবধি। 


ছোট যমুনা নদী বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় বড় চণ্ডীপুর বিল থেকে উৎপত্তি হয়ে দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর, ফুলবাড়ি, হাকিমপুর ও বিরামপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এরপর নদীটি চৌঘরিয়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। নদীটি পুনরায় দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার আপ্তাই ও উজলের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পাঁচবিবি উপজেলার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অতঃপর জয়পুরহাট জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এ নদী নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলায় প্রথমে ঘুকসী নদী ও পরে তুলসীগঙ্গা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। তিন নদীর মিলনস্থলটি ত্রিমোহনী নামে খ্যাত। এরপর সম্মিলিত ধারাটি ছোট যমুনা নামে প্রবাহিত হয়ে সবশেষে আত্রাই উপজেলায় আত্রাই নদীতে মিলিত হয়েছে। এ পরিক্রমায় নদীটি অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে। 

নদীটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেকটাই উপেক্ষিত। অথচ পুণ্ড্র-বরেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রশাসনিক কেন্দ্র – পঞ্চনগরী ও কোটীবর্ষকে স্পর্শ করে বয়ে চলেছে নদীটি। এর ফলে এ নদীর তীরে অনেক প্রত্নক্ষেত্র বিদ্যমান। বাংলাদেশের ফুলবাড়ি, বিরামপুর, হাকিমপুর উপজেলা ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ অঞ্চল। আবার পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ দিনাজপুরও তেমনি সমৃদ্ধ। এর ফলে ছোট যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলে আবিষ্কৃত ও অনাবিষ্কৃত প্রচুর প্রত্নস্থান রয়েছে। 


এখন ছোট যমুনার তীরবর্তী ঐতিহাসিক স্থাপনার অবস্থানের ক্রম অনুসারে আমরা পর্যবেক্ষণ করবো। শুরু করবো পাঁচবিবি উপজেলায় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশমুখ থেকে নদীর ত্রিমোহনী মুখ পর্যন্ত। 

ক্রমের প্রথমেই পড়বে বৃটিশ আমলের "লালবাজার থানা"। জয়পুরহাট জেলা সৃষ্টির আগে বৃটিশ আমলে ছোট যমুনার তীরে স্থাপিত হয় লালবাজার থানা। বর্তমানে জয়পুরহাটের করিমনগর স্কুলের কাছেই এ থানাটি ছিল এবং এখনো এখানকার নদীর ঘাট "থানার ঘাট" নামে পরিচিত। পরবর্তীতে বৃটিশদের দ্বারা জেলা ও মহকুমার পুনর্বিন্যাস ঘটে ১৮২১ সালে। এখনকার শীর্ণকায়া ছোট যমুনা যে বৃটিশ আমলেও ব্যবসা বাণিজ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। 

এরপরে ছোট যমুনা নদীর সাথে পথ চললে বৃটিশযুগ থেকে সহসাই পিছিয়ে চলে যাবেন পাল ও সেন আমলে। পেয়ে যাবেন বেল আমলা গ্রামের বারো শিবালয় মন্দিরগুলো ও অতি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। এ নদীর তীরে এখনো শিবরাত্রি উপলক্ষে নদীতে স্নান ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বারো শিবালয় মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ধনী গন্ধবণিক রাজীবলোচন মণ্ডলের বড় বড় বাণিজ্যতরী ও বিলাসবহুল বজরা যে একসময় ছোট যমুনার বুকে দাপিয়ে বেড়াতো আজকের দিনে শীর্ণকায়া নদীটি দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হয়। 





আমরা এবার আরো এগিয়ে গেলে পেয়ে যাবো জয়পুরহাট জেলার প্রাচীন ও বিরাট মহাশ্মশান এবং আরেকটু এগোলে আবারো বৃটিশ আমলে গিয়ে পড়বো। ছোট যমুনার তীরে বৃটিশরা ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য স্থাপন করে বিরাট এক নীলকুঠি। জয়পুরহাটের খনজনপুর এলাকায় সেই নীলকুঠির স্থাপনাগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; জায়গাটি কুঠিবাড়ি নামেই পরিচিত। এছাড়া খনজনপুরে সরকারী বিভিন্ন দপ্তর স্থাপন করে বৃটিশরা। সেসময়ের খরস্রোতা ছোট যমুনার বুকে চলতো বৃটিশদের পণ্যবাহী নৌকা। এসময় ধর্মপ্রচারক সাহেবরা এসে ডেরা বাঁধেন এ এলাকায়। তাঁরা খনজনপুরে খ্রিষ্টান মিশন, চার্চ ও আবাসিক দালান-কোঠা তৈরী করে যীশুর বাণী প্রচার করতে থাকেন। নীলকুঠির আশেপাশে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বাস করে, যারা এখনো বাঁশের তৈরী কুলা, চালুনি, ডালা প্রভৃতি বানিয়ে থাকে। খ্রিষ্টান মিশনারিদের সংস্পর্শে এসে এদের অনেকে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহন করে। এখনো এখানকার মিশনের খ্যাতি দেশ-বিদেশে বিদ্যমান।

বরেন্দ্রীর পথে আরেকটু এগিয়ে যাই ছোট যমুনা নদীর সাথে। দুটি প্রাচীন ঘাট দেখতে পাবেন – পাথুরিয়া ঘাট ও দোআনী ঘাট। নাটোর জমিদারের স্মৃতিবাহী দোআনী ঘাটে এখনো বারুণী স্নানের সময় মেলা বসে।

এরপরের যাত্রাপথে পড়বে দুই বাংলার সবচেয়ে গর্বের স্থাপত্যগুলোর অন্যতম – সোমপুর মহাবিহার। আমরা এসে হাজির পালযুগের প্রথম পর্যায়ের বরেন্দ্রীতে; মহারাজ গোপাল গত হয়েছেন, সম্রাট ধর্মপালদেব সোমপুর মহাবিহার স্থাপনের মহাকর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন। বরেন্দ্রীতে পাথর মহার্ঘ, তাই নৌপথে সুদূর রাজমহল থেকে আসছে মহাবিহারের স্তম্ভ নির্মাণের পাথরখন্ড। রাজমহল থেকে গঙ্গা পেরিয়ে আত্রেয়ী হয়ে পাথরবাহী নৌকা এসে পৌঁছে গিয়েছে ছোট যমুনার ঘাটে - সম্ভবত পাথুরিয়া ঘাটে, "পাথুরিয়া" নাম সে কারণেই বুঝি। সেখান থেকে পাথরগুলো চলে যাচ্ছে সোমপুর মহাবিহারে – নির্মাণ হচ্ছে বাঙালির চিরগর্বের স্থাপত্য। সেসময় ছোট যমুনা প্রবহমান ছিল সোমপুর মহাবিহারের একদম পাশ দিয়ে। কালের পরিক্রমায় গতিপথ বদলে এখন দূরে দিয়ে বইছে ছোট যমুনা। কিন্তু তার মরাখাত এখনো রয়ে গেছে; বালু উত্তোলন করা হয় বর্তমানে। সোমপুর মহাবিহারের স্নানঘাটের চিহ্নও আজো বিদ্যমান। এক বিরাট কর্মযজ্ঞের সাক্ষ্য আজকের ছোট যমুনা নদী।


আমাদের শেষ গন্তব্য ছোট যমুনার মোহনায় – ত্রিমোহনীতে। সোমপুর মহাবিহারের মতো জগদ্দল মহাবিহার নির্মানের পাথরবাহী নৌকা সম্ভবত আত্রাই নদী দিয়ে এ মোহনা বেয়ে ঘুকসী নদীর পথ ধরেছিল। আজও ঘুকসী নদী জগদ্দল মহাবিহারের কোল বেয়ে চলেছে। ত্রিমোহনীতে মহিমান্বিত ছোট যমুনা। এখানে রয়েছে বিখ্যাত সন্ন্যাসতলা, যেখানে প্রতিবছর স্নান ও মেলা বসে। সমগ্র অঞ্চলে এ মেলার সুনাম বিরাজমান। 

এবার থামতে হবে!

পরিশেষে, বাংলাদেশে নদীগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে গবেষণা খুবই কম। কাল পরিক্রমায় বারবার নদীগুলো গতিপথ বদলেছে। তাই প্রাচীনকালের রুটগুলো নিশ্চিতভাবে খুঁজে পাওয়া এখন বেশ দুষ্কর। তবে রেনেলের ম্যাপ ও কিছু পুরনো গ্রন্থ ভরসাস্থল। গবেষকগণ যদি এ বিষয়ে নজর দেন, তবে আমাদের নদীপথের স্বরূপ ও ব্যবহারিক দিকগুলো আমরা জানতে পারবো। সেই সাথে নদীগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্বও আমরা জানতে পারবো। বরেন্দ্রীতে নিজের জেলার দুটি নদীকে আমি দেখার চেষ্টা করেছি ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে। ঘুরে বেড়িয়েছি নানা জায়গায়, নদীগুলোকে যত দেখেছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি, ভাবিত হয়েছি ইতিহাস জানার জন্য। এ লেখনীটি তারই একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র; সাফল্য-ব্যর্থতা পাঠকের হাতে।

তথ্যসূত্র: 

১. বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব), নীহাররঞ্জন রায়

২. বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা (জয়পুরহাট), বাংলা একাডেমি

৩. উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তি, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, প্রবাসী, কার্তিক ১৩১৫

৪. সরকারি তথ্য বাতায়ন 

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)