ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১৭ তম পর্ব)

|| একটি দেউল ও মূক ইতিহাস ||




কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "ছুটি" গল্পটি পড়েন নি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের স্কুলে পাঠ্যবইয়ে ছিল গল্পটি। যখনই পড়েছি, মনটা ব্যথিত হয়েছে; বিশেষত যে সময়ে গল্পটি পড়তাম, তখন নিজেও ফটিকের বয়সী, মানে নিজেও একটা বালাই। মামা বাড়িতে অনাহূত ফটিকের শেষ কথাদুটি আসলে মর্মবেদনার মূল কারণ – "মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।" এ কথার সুর এখনো মর্মে বাজে।

গম্ভীর পাঠকগণ ইতোমধ্যে বিরক্ত হয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের লেখায় 'ছুটি' গল্পের অবতারণা করার জন্য। কারণটি পরিষ্কার বুঝে যাবেন লেখাটির শেষভাগে।

গত ৮/১০ দিন আগে নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলায় "যোগীর ঘোপা" নামক একটি প্রত্নস্থল দেখে বাড়ি ফিরছি। সবে ৩/৪ কিলোমিটার পথ এগিয়েছি, সহসা গাছগাছালির ভীড়ে মাথা উঁচিয়ে থাকা একটি শিখর চোখে পড়ল। অমনি নেমে পড়া। রাস্তার পাশে দোকানের সাইনবোর্ডে জায়গার নাম লেখা "বকুলতলার মোড়"; জায়গাটি ১০ নং আমইড় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত, উপজেলা পত্নীতলা, জেলা নওগাঁ। 
কয়েকজন বয়োবৃদ্ধ একটি মুদি দোকানের মাচায় খোশগল্পে মেতে আছেন। তাঁদের জিজ্ঞেস করতে বললেন, এটি একটি প্রাচীন মন্দির, কিসের মন্দির জানেন না। কাছে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। একটু ঘুর পথে এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দূর থেকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এগিয়ে গেলাম আরো সামনে।

গুপ্তযুগে শিল্প ও সংস্কৃতির উৎকর্ষতার কোন এক পর্যায়ে মন্দির নির্মাণে দ্রাবিড় রীতি ও নাগর রীতি এ দুইটি দেউল নির্মাণরীতির উদ্ভব ঘটে। দ্রাবিড় রীতি দাক্ষিণাত্যে এবং নাগর রীতি সমগ্র পূর্ব ও উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাতেও এ রীতির আগমন ঘটে। তবে দেশীয় শিল্পীর হাতে এ দেশের চিন্তার মিশ্রণ ঘটে নাগর রীতির সাথে। কালের বিবর্তনে দেশীয় চালা রীতি ও নাগরী শিখর রীতির মিশ্রণে তৈরী হয় নতুন একটি ধারা – রত্নমন্দির। সারা বাংলায় পঞ্চরত্ন প্রভৃতি মন্দিরের সমারোহ এ ধারার সাক্ষ্যবাহী।
রাঢ় অঞ্চলে সৌভাগ্যবশত আজো অনেক শিখর দেউল চোখে পড়ে, বিশেষত বাঁকুড়া, বর্ধমান, বিষ্ণুপুর অঞ্চলে। বাংলাদেশে বাগেরহাটের অযোধ্যা মঠ ও ফরিদপুরের মথুরা দেউল শিখর রীতির দৃষ্টান্ত। এ দুটি জায়গা ছাড়া বাংলাদেশে খুব বেশি এরূপ দেউল নেই। বরেন্দ্রীতে দেউলরীতির স্থাপনা নেই বলেই জানতাম। সে হিসেবে এত বিশাল ও উৎকৃষ্ট শিল্পমানের দেউল দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। স্থাপনার ভিত্তি দেওয়ালে যে একসময় চমৎকার কারুকার্য ছিল, তা বিনষ্ট হয়ে গেলেও সহজে ধারণা করা যায়। শিখরের ইটের কারুকার্যও প্রশংসনীয়। 






গঠনরীতি অনুযায়ী এটি শিখর দেউল রীতিতে নির্মিত মঠ, সম্ভবত ষোড়শ বা সপ্তদশ শতকের স্থাপনা। কোন সাধক বা সম্মানিত ব্যক্তির স্মৃতির স্মরণে এ ধরণের দেউল নির্মাণ করার প্রচলন ছিল একসময় এ বাংলায়। যদিও স্থাপনাটি মন্দির নামে আশেপাশের লোকজনের নিকট পরিচিত, গঠনশৈলী হিসেবে এটি কোন অজানা সম্মানিত ব্যক্তির পূণ্য স্মৃতিবাহক মঠ। অবস্থান বিচার করলে, এটির অতি সন্নিকটে নাথ সম্প্রদায়ের অতি প্রাচীন ধর্মস্থান, যোগীর ঘোপা, এ মঠটি কোন মহান নাথ সাধকের হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে আরে গবেষণার সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি। সময় ও সুযোগের অভাবে আমি বিশদে জানার সুযোগ পাইনি। সরকারী খাতায়ও এর নাম নেই, কারণ ঐ ইউনিয়নের ওয়েবসাইটে এ দেউলের উল্লেখ নেই এবং দেউলের সামনে কোন সাইনবোর্ডও নেই। নিঃসন্দেহে এ স্থাপনাটি বরেন্দ্র অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা এবং এটি সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যক।






এবার আসি লেখার শুরুতে বলা 'ছুটি' গল্পের সাথে মঠটির সম্পর্কের বিষয়ে। 

দেউলের চূড়া লক্ষ্য করে কাছে গিয়ে যারপরনাই হতাশ হতে হলো। স্থাপনাটির দুইদিকে বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে এবং ঘেরা জায়গায় শাকসবজি লাগানো হয়েছে। দেউলটির আরেকদিকে সামান্য জলাবদ্ধ ডোবার ন্যায়। সবচেয়ে কষ্ট পেলাম দেউলের সম্মুখভাগের অবস্থা দেখে। দেউলের সামনে টিন দিয়ে ঘিরে টয়লেট বানানো হয়েছে। তারপাশে আবার ময়লা ও গোবর ফেলার জায়গা হয়েছে। আশেপাশের বাসিন্দাদের পাকা বসতবাড়ি থাকার পরেও বাহিরে এহেন কাঁচা টয়লেট কেন ভেবে পেলাম না। তবে একটা বিষয় সুস্পষ্ট, কেউ যেন দেউলটির কাছে না যেতে পারে সেজন্য এ ব্যবস্থা। এই যে সবজি লাগানো, কাঁচা টয়লেট, গোবর ফেলার জায়গা সবই দেউলটিকে আর সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যই করা হয়েছে। আমাকেও ৮/১০ হাত দূর থেকে জুম করে ছবি নিতে হয়েছে, কাছে যাওয়ার রাস্তা পাইনি। 

দেখলাম আশেপাশের বাসিন্দারা মুসলমান। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলার হিন্দুরা তাদের জমিজমা পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের সাথে বিনিময় (Exchange) প্রথায় হস্তান্তর করে ভারতে চলে যায় এবং মুসলমানরা এদেশে চলে আসে। এভাবে যে মুসলমানরা এদেশে এসেছে, বরেন্দ্রীতে তাদেরকে "রিফুজি বা রিফিউজি" অর্থাৎ "ভারত থেকে আগত" বলা হয়। শুনেছি ওপার বাংলায় চলে যাওয়া পূর্ব বাংলার হিন্দুদের "বাঙাল" বলা হয়। যোগীর ঘোপা দেখার সময় জানলাম আশেপাশের গ্রামে অনেক এমন মুসলমানদের বসতি ও জমিজমা আছে। আমার মনে হয়, এই দেউলটি যার জায়গায়, তারাও বিনিময়ের মাধ্যমে এ জমিগুলোর মালিকানা পেয়েছে। ফলে মুসলমান মালিকের জায়গায় হিন্দু স্থাপত্য রয়ে গেছে। ফলে দেউলটি এখানে অনাহূত, অপ্রত্যাশিত। 

ছুটি গল্পের ফটিকের মতোই দেউলটি অনাহূত অতিথি; শত গঞ্জনা নিয়েও ঠায় দাঁড়িয়ে। যার জমিতে দাঁড়িয়ে আছে, তার মন-মর্জি হলে একদিন হয়তো দেউলটিরও ছুটি হয়ে যাবে।

তথ্যসূত্র:

১. বাংলার মন্দির, হিতেশরঞ্জন সান্যাল
২. বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব), নীহাররঞ্জন রায়
৩. হিন্দু মন্দির: স্থাপত্যিক পরিচয়, মোঃ মাহবুব উল আলম, মোহা. মোশাররফ হোসেন

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)