ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১৮ তম পর্ব)

|| করতোয়ার লুপ্ত বাণিজ্য গৌরব ||



করতোয়াং সমাসাদ্য ত্রিরাত্রোপোষিতো নরঃ।
অশ্বমেধমবাপ্নোতি প্রজাপতিকৃতা বিধিঃ।।

পুণ্ড্রনগরের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা একসময়ের প্রমত্তা ও বিপুলকায়া করতোয়া নদী আজ শীর্ণকায়া। করতোয়ার পূণ্যকথা ও তীর্থ মাহাত্ম্য নিয়ে মহাভারত ও পুরাণাদিতে অনেক কথা বলা হয়েছে, যা আমরা কমবেশি শুনেছি ও পড়েছি। 

তবে ধর্মেতিহাস ছাড়াও করতোয়ার আছে গৌরবময় বাণিজ্যের ইতিহাস। এ নদীর বুক দিয়ে যাতায়াত করতো বিশাল বাণিজ্য তরী; ফলে পুণ্ড্রের অর্থনীতি থাকতো সচল, কোষাগার ভরে উঠতো অর্থে। গ্রীকদের কাছেও এ নদী ছিল সুপরিচিত, যার প্রমাণ মেলে "দি পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি" বইতে। 
করতোয়া তীরের সে সময়ের বাণিজ্য বন্দরগুলোর নাম এখনো রয়ে গেছে। গতিপথ বদলে করতোয়া চলে গিয়েছে দূরে, বন্দরের নামটা ঠিকই রয়েছে। আধুনিক বগুড়ায় চণ্ডীহারা বন্দর, মোকামতলা, নাগর বন্দর এখনো স্থলবন্দর হিসেবে বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজ্যে অবদান রেখেই চলেছে। এমনকি পুণ্ড্রনগরের সুরক্ষা প্রাচীরের কাছেই অবস্থিত "জাহাজঘাটা" প্রত্নস্থল গৌরবময় সেই বাণিজ্যের সাক্ষ্যবাহী। 

আজকের লেখাটি করতোয়ার বাণিজ্য গৌরবের সংক্ষিপ্ত কথা, বলতে পারেন Appetizer, বিস্তারিত কথা আরেকদিন লিখবো। এখন আমরা বৃটিশ আমলে করতোয়ার ঘাট থেকে সংগৃহীত রাজস্বের একটা ছোট হিসেব তুলে ধরতে চাই। 

১৮৫০ সাল থেকে বৃটিশরা করতোয়া নদী দিয়ে চলাচলকারী বিপুল সংখ্যক নৌযান থেকে কর আদায়ের দিকে নজর দেয়। সেসময় করতোয়ার নাব্যতা বাড়ানোর কিছু উদ্যোগ নেয় সরকার। ১৮৫৬ সালে করতোয়ায় রাজস্ব আদায়ের আইন প্রণীত হয় এবং কলকাতার প্রসন্নকুমার ঠাকুরকে এ কর আদায়ের সনন্দ প্রদান করা হয়। খানপুর, গোঁসাইপুর ও শিবগঞ্জ এ তিনটি ঘাটে এ কর আদায় চলতো, তবে শিবগঞ্জে আদায় সবচেয়ে বেশি। 

১৮৬৩ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮৬১ সালে করতোয়ায় মোট নৌযান সংখ্যা ২২১৭১ টি এবং ১৮৬২ সালে ২৩২৩৭ টি। দুই বছরে মোট নৌযান সংখ্যা ৪৫৪০৮ টি। এর সংক্ষিপ্ত হিসাব:

বানিজ্য নৌকা: ৩৬২৯৭
পথিক নৌকা: ৮৬২৬
বাঁশের ভুর: ৪২৬
কাঠের চালি: ৫৯

এ সমস্ত নৌকা থেকে মোট আদায়কৃত কর ২৯৪০ পাউন্ড ৬ শিলিঙ। সুস্পষ্টত, করতোয়া এ সময় পর্যন্ত বাণিজ্যের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হতো, যদিও এর আগেই ১৭৮৭ সালে বন্যার কারণে এর গতিপথ পরিবর্তন হয় এবং এটির নাব্যতা ক্রমশ কমে আসছিল।

দূর্ভাগ্যক্রমে বৃটিশরাজের কাছে প্রতি বছর নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির খরচ আদায়কৃত রাজস্বের চেয়ে বেশি মনে হতে থাকে। ফলে ১৮৬৫ সাল থেকে কর আদায়ের সনন্দ বাতিল করা হয়। ফলে নদীটির বাণিজ্যিক ব্যবহার কমতে থাকে। আর এভাবেই এক সময়ের প্রমত্তা করতোয়া কালের বিবর্তনে শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে পড়ে। আজকের নদীটিকে দেখলে ইতিহাসের সবকথাই রূপকথা মনে হয়। 


তথ্যঋণ:

১. পৌণ্ড্রবর্দ্ধন ও করতোয়া, শ্রীহরগোপাল দাসকুণ্ডু
২. মহাভারত

ছবিটি মহাস্থানগড় (পুণ্ড্রনগর) এর গোবিন্দ ভিটার উপর থেকে তোলা।

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)