ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (১৯ তম পর্ব)

|| পাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে একদিন ||



পাঁচ বছর আগের কথা। ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে খাঁচাছাড়া পাখির মতো উড়ে চলেছি বাড়ির দিকে – আপন শহরে। যারা উত্তরবঙ্গে নিয়মিত যাতায়াত করেন, প্রায় সবারই হানিফ পরিবহনের বাসে চড়ার অনুভূতি নিশ্চয় আছে। দূরপাল্লার বাসটির লোগোর নীচে লেখা স্লোগানটি হলো "সড়কপথে বিমানের ছোঁয়া"। মানে বুঝতেই পারছেন, এ বাসে চড়লে সারা রাস্তা ইষ্টনাম করতে হয়, এত দ্রুত ও বেপরোয়া এরা। পারতপক্ষে এ বাসটিতে যাই না। সেবার বিধি বাম, ঈদ বলে কথা। অন্য বাসে সুযোগ না পেয়ে উঠে পড়লাম সব দোয়া-দরুদ পড়ে আর কি! রাস্তায় ঈদের ছুটির সময়কার তীব্র যানজট। 

ঢাকা ছাড়ার পথে জ্যাম ঠেলতে ঠেলতে আমাদের বাসটি হুস করে শর্টকাট নিয়ে ঢুকে পড়লো অন্য রাস্তায়, সাইনবোর্ড পড়ে বুঝলাম মানিকগঞ্জ - টাঙ্গাইল বাইপাস সড়ক। সচরাচর এসব রাস্তায় বড় গাড়ি চলে না, ঈদের সময় বলে অনেক গাড়ি চোখে পড়লো, এদিকপানেও জ্যাম, সব গাড়ির ঢিমে গতি। অনেকটা সময় চলার পথে হঠাৎই চোখ আটকে গেল মাঠ পেরিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদোপম একটি বাড়ির দিকে। গাড়ি থেকে সবটা দেখা গেল না, কিন্তু মনটা সেখানে আটকে রইলো। পরে ইন্টারনেটের বদৌলতে জানলাম বাড়িটি পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। পরে এসে দেখবো ভেবে রাখলাম। সময় পেরিয়ে গেলেও এতদিনে হয়ে উঠছিল না নানা কারণে। অবশেষে গত শুক্রবার (03/09/21) সে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। দেখা হলো পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। 


পাকুটিয়া জমিদার (Pakutia Zamindar Bari) বাড়িটি ঢাকা বিভাগের টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার পাকুটিয়া ইউনিয়নে মানিকগঞ্জ-টাঙ্গাইল সড়কের পাশেই অবস্থিত। জমিদার বাড়ির সামান্য দূর দিয়ে বয়ে চলেছে আঁকাবাকা লৌহজং নদী, বেশ প্রশস্ত ও স্রোতস্বিনী নদীটি।





জমিদার বাড়িটির বিস্তারিত লিখিত ইতিহাস আশানুরূপভাবে পাওয়া যায় না। যতটুকু জানা যায় তা হল, বাংলার সুপ্রাচীন ও প্রসিদ্ধ বিষ্ণুপুর এস্টেট থেকে রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল নামের একজন ব্যবসায়ী ব্যক্তি উনবিংশ শতকের শুরুতে লৌহজং নদীর পাড়ে ছনকা নামক জায়গায় বসতি স্থাপন করেন ব্যবসায় করার জন্য। সে সময় লৌহজং নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকে এবং অনেক বণিক সম্প্রদায় এখানে বসতি গড়ে তোলেন। প্রমত্তা লৌহজং নদীর ভাঙনের কারণে রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডল ছনকা থেকে এসে পাকুটিয়ায় বসবাস শুরু করেন। ব্যবসায় উন্নতির ফলে একসময় ইনি বেশ বিত্তশালী হয়ে উঠেন এবং বৃটিশরাজের কাছ থেকে জমিদারির সনন্দ লাভ করেন।



রামকৃষ্ণ সাহা মন্ডলের দুই ছেলে বৃন্দাবন চন্দ্র ও রাধা গোবিন্দ। রাধা গোবিন্দ নিঃসন্তান ছিলেন। বৃন্দাবন চন্দ্রের তিন ছেলে – ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন এবং যোগেন্দ্র মোহন। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি তিনটি ভাই বা তরফে ভাগ হয়ে পড়ে। ১৯১৫ সালে তিন ভাইয়ের আলাদা মহল তৈরী হয়। আর এভাবে পাকুটিয়া জমিদারি পরিচিত হয় তিন তরফ বা তিন মহলা জমিদারি নামে। 








পাকুটিয়া জমিদাররা প্রজাবৎসল ছিলেন বলে জানা যায়। জমিদার বাড়ির আশেপাশে বড় বড় পুরনো পুকুরগুলো তাঁদের অবদান বলে মনে হলো। কারণ, জমিদার বাড়ির লাগোয়া একটি বড় দীঘি মেজ জমিদার উপেন্দ্র মোহনের নামে "উপেন্দ্র সরোবর" বলে খ্যাত। পাকুটিয়া জমিদারদের চিরস্মরণীয় একটি কীর্তি বিসিআরজি (BCRG) উচ্চ বিদ্যলয়। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিন জমিদার ভ্রাতা তাঁদের পিতা বৃন্দাবন চন্দ্র ও পিতৃব্য রাধা গোবিন্দের নামে বৃন্দাবন চন্দ্র রাধা গোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয় – বিসিআরজি (BCRG) প্রতিষ্ঠা করেন। ডঃ এ. আর. মল্লিক, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, ভবা পাগলা প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৃতি সন্তান ছিলেন। দেশভাগের সময় পাকুটিয়া জমিদারগণ ভারতে চলে যান। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার জমিদারের সকল সম্পত্তি অধিগ্রহন করেন এবং এখানে বিসিআরজি (BCRG) ডিগ্রী কলেজ স্থাপন করা হয়। বর্তমানে জমিদারের তিনটি মহল এ কলেজের অধীনে। 








পাকুটিয়া জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য অসাধারণ এবং জমিদারের বিত্ত-বৈভব ও রুচিশীলতার পরিচায়ক। প্রতিটি বাড়ির গায়ে যে তরফের বাড়ি, তাঁর নাম ও নির্মানকাল লেখা আছে। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ এপ্রিল, ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২রা বৈশাখ। নববর্ষের পরদিন নতুন মহলের নির্মাণ; না জানি কত আতশবাজি, নাচগান, হৈ-হল্লা আর উৎসবের সে দিনটি ছিল! আজ সবই শুনশান নীরবতায় পর্যবসিত, ধীর লয়ে নিঃশেষের পথে।

সুউচ্চ অট্টালিকার সারা গায়ে ফুল-পাতার মনোহারিণী কারুকার্য আর প্রাসাদশীর্ষে ফুল-পাতার অলংকরণ সম্বলিত দুই অপ্সরার ন্যায় নারীমূর্তি এর শোভা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিটি অট্টালিকার শিরোভূষণ যেন এগুলো। দ্বিতল বাড়ির কার্নিশের কারুকাজ এবং দোতলার বারান্দার রেলিঙের সৌন্দর্য দেখতে গিয়ে নির্বাক হয়ে যাই। 








দোতলার রেলিঙে নির্বাক নারীমূর্তিগুলো অতুলনীয়। মূর্তিগুলো দেখে আমার মনে পড়ে যায় বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের "মেঘমল্লার" গল্পটির কথা। সেই যে অরণ্যের মাঝে প্রদ্যুম্ন নামের যুবকটি দেবী সরস্বতীকে সন্ন্যাসীর ইন্দ্রজাল থেকে মুক্ত করে নিজে পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। তারপর কেউ তার খোঁজ রাখেনি একমাত্র তার প্রেয়সী ছাড়া। ঘন অরণ্যে রয়ে যায় প্রদ্যুন্মের পাথর হয়ে যাওয়া মূর্তিটি। কেমন ব্যথাতুর হয়ে যায় মনটি, বিচ্ছেদের সুর ভেসে বেড়ায় বাতাসে। রেলিঙের নারীমূর্তিগুলো যেন তেমনি স্বর্গের অপ্সরা, অভিসারে এসে নায়কের বাহুপাশে আটকে পড়ে, ফিরে যেতে পারেনি রাত ফুরিয়ে যাওয়ায়। তাই পাথর হয়ে গিয়ে কোন পরশপাথরের অপেক্ষায় আছে আজো। হয়তো একদিন জেগে উঠবে। আলো আঁধারিতে কিসের যেন ফিসফিসানি। বড় মায়াময় লাগে দেখতে। 








বড় তরফ ব্রজেন্দ্র মোহনের বাড়ির সামনে বিশাল পূজামণ্ডপ, বিগ্রহশূণ্য বিষন্নতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরটির কারুকার্য মুগ্ধকর, নকশাগুলো এখনো বেশ বোঝা যায়। কি দারুণ সব ঐশ্বর্য!

এত বিপুল ঐশ্বর্য কতো অবহেলিত আজকে। কলেজ কর্তৃপক্ষ নতুন বিল্ডিংয়ে চলে গিয়েছে। আর এ মহলগুলো ভাড়া দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে দালানগুলো ক্ষতির সম্মুখীন। বড় তরফের বাড়িতে কয়েকটি পরিবার বাস করছে, শুনেছি কলেজের শিক্ষকের পরিবার। অযত্ন ও অবহেলার ছাপ প্রতিটি মহলে। নির্বিচারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এক একটি কারুকার্য। অনেক জায়গায় রেলিং ভেঙে গেছে। বট-পাকুরের গাছ গজিয়েছে, শৈবালের সবুজ আস্তরণ ক্রমশ ছেয়ে ফেলছে সবটা। সকলি ধ্বংসের পথে। দেখার কেউ নেই। অথচ এত চমৎকার স্থাপনা নিঃসন্দেহে বাঁচার দাবী রাখে। চাইলেই আমরা এখানে পর্যটনের সুযোগ তৈরী করতে পারি। নইলে কোনদিন দেখব, উন্নয়নের নামে মহলগুলো ভেঙে নতুন দালান উঠবে। আর কত ঐতিহাসিক স্থাপনা হারালে আমাদের ঘুম ভাঙবে? অবশ্য জেগে থেকেও ঘুমায় যারা, তাদেরকে জাগানো সম্ভব নয় – এ ঘুম কুম্ভকর্ণের চেয়েও গাঢ় যে!

তথ্যসূত্র:

১. সরকারী তথ্য বাতায়ন

২. নিজস্ব ক্ষেত্রসমীক্ষা 

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)