ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (২০ তম পর্ব)

|| বালিয়াটি জমিদার বাড়ির কথা ||


১৭৭২ সালের ৩রা নভেম্বর। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস লন্ডনে বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের চিঠি লিখে রিপোর্ট  জানাচ্ছেন বাংলায় রাজস্ব আদায় ও অন্য বিষয়ের হাল-হকিকত। ইতিহাসে এ রিপোর্টের কথাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর দু'বছর আগে ১৭৭০ সালে ঘটে গিয়েছে বাংলার ট্র্যাজিক একটি অধ্যায় – ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গিয়েছিল এ করুণ দুর্ভিক্ষে। 

ইতিতাসের অনেক পালাবদলের সূচনা হল এ সময়ে। বালিয়াটি জমিদার বাড়ির কথা বলার আগে হেস্টিংসের রিপোর্টের খুব সামান্য কয়েকটি তথ্যে আলোকপাত করতে চাই আজকে। হেস্টিংসের পাঠানো রিপোর্ট অনুযায়ী ১৭৬৮ থেকে ১৭৭২ সাল পর্যন্ত বাংলায় আদায়কৃত মোট রাজস্বের একটি ছোট্ট হিসেব:

ক. ১৭৬৮ – ৬৯ সাল: ১৫২,৫৪,৭৫৬ টাকা

খ. ১৭৬৯ – ৭০ সাল: ১৩১,৪৯,১৪৮ টাকা

গ. ১৭৭০ – ৭১ সাল: ১৪,০০৬,০৩০ টাকা [দুর্ভিক্ষ]

ঘ. ১৭৭১ – ৭২ সাল: ১৫৭,২৬,৫৭৬ টাকা

সুচতুর হেস্টিংস সাহেব জানতেন বোর্ডের মনোভাব। তাই এতবড় দুর্ভিক্ষের সময়ও রাজস্ব একই হারে আদায়ের বিষয়ে বিশদে লিখলেন। জানালেন, রাজকর্মচারী, বিশেষত কালেক্টরদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে এবং খাজনা আদায়ের বিষয়ে একচুল ছাড় না দেওয়ায় এ খাজনা আদায়ে ভাটা পড়েনি। সেই সাথে জানালেন, প্রজাদের পাশাপাশি জমিদারদের নিঃস্ব হওয়ার কথা। আরেকটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বাংলার জমিদাররা ১৪০,০০,০০০ টাকা মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চহারে ঋণ নিয়ে দুর্ভিক্ষের বছর ও পরের বছরের খাজনা পরিশোধ করে। আর এভাবে নবাবী আমলের জমিদারদের পাশাপাশি আরেকটি মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি হল – মহাজন। পরবর্তীকালে উনবিংশ শতাব্দীতে এ সকল ব্যবসায়ী মহাজন থেকে উঠে এলো নব্য জমিদারগণ, যারা প্রজাহিতৈষী হওয়ার চেয়ে মুনাফা অর্জনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। তবে জনদরদী অনেক জমিদারও ছিলেন তাঁদের মধ্যে। 

বাংলায় জনহিতৈষী যে সকল জমিদারের কথা জানা যায়, বালিয়াটি জমিদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এ জমিদারও পূর্বে বণিক ছিলেন, লবণ ব্যবসায়ী। একসময় বালিয়াটির জমিদারীর সীমানা নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। বণিক থেকে জমিদার হলেও এ পরিবারটি জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য, বিশেষত শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক অবদানের জন্য চিরস্মরণীয়। 


সরকারী তথ্য বাতায়ন থেকে জানা যায়, লবণ ব্যবসায়ী গোবিন্দরাম সাহা বালিয়াটিতে জমিদার বংশটির পত্তন করেন অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকারের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন জগন্নাথ রায়চৌধুরী, তস্যপুত্র কিশোরীলাল রায়চৌধুরী, ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং তস্যপুত্র রায়বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার রায়চৌধুরী। এঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় সহজেই পাওয়া যায়, যার কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁদের অবদানের জন্য। 


১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে কিশোরীলাল রায়চৌধুরী তাঁর পিতা জগন্নাথ রায়চৌধুরীর নামে জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৯৯৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। কিশোরীলাল রায়চৌধুরী নিজের নামে ঢাকার নর্থব্রুক স্ট্রীটে প্রতিষ্ঠা করেন কিশোরীলাল জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়। এ স্কুলে বাঙালির গৌরব বিজ্ঞানী ড. মেঘনাদ সাহা বিনা বেতনে অধ্যয়ন করেন এবং ১৯০৯ সালের ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে এ বিদ্যালয়ে মেঘনাদ সাহার নামে একটি বিজ্ঞানাগার স্থাপন করা হয়। এছাড়া কিশোরীলাল রায়চৌধুরী বালিয়াটিতে একটি অ্যালোপাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। 

রায়বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার রায়চৌধুরী তাঁর পিতা ১৯১৯ সালে তাঁর পিতা ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরীর নামে নিজ গ্রাম বালিয়াটিতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। আজো এ সমস্ত শিক্ষাপীঠে হাজারো শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে এবং দেশ ও দশের সেবায় বেড়িয়ে পড়ছে। কত মহৎ কীর্তি রেখে গিয়েছেন বালিয়াটি জমিদার পরিবার। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তাঁদের!

এখন বালিয়াটি জমিদারবাড়ি নিয়ে কয়েকটি কথা বলা যাক। 

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি (Baliati Palace) বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত মানিকগঞ্জ জেলার সদর থেকে আনুমানিক আট কিলোমিটার পশ্চিমে এবং ঢাকা জেলা সদর থেকে পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে অবস্থিত। 








উনবিংশ শতকে নির্মিত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্র রীতিতে অত্যন্ত নান্দনিক স্থাপত্য বালিয়াটি প্রাসাদ। প্রায় ১৬,৫৫৪ বর্গমিটার জায়গা জুড়ে এটি নির্মিত। বিশাল তিনটি সিংহদরজা প্রাসাদটির গৌরব যেন আরো বাড়িয়ে দেয়। সিংহ দুয়ার পেরিয়ে একটু সামনে এগোলেই সুবিশাল প্রাসাদ চোখে পড়বে।  পরপর তিনটি প্রাসাদোপম সামনের অট্টালিকাগুলো বাহির মহল নামে পরিচিত। বাহির মহলের সামনে শুকিয়ে যাওয়া জলের ফোয়ারা রয়েছে একটি। বাহির মহলগুলো জমিদারির কাজের জন্য ব্যবহৃত হতো। মাঝের বাহির মহলটিতে জমিদার পরিবারের বিভিন্ন ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে জাদুঘর বানানো হয়েছে। 


বাহির মহলের পেছনে পরপর তিনটি মহল, যেগুলো অন্দরমহল নামে পরিচিত। জমিদারের পরিবারবর্গ এগুলোতে বসবাস করতেন। অন্দরমহলের পেছনে আরেক সারি স্থাপনা রয়েছে, যেগুলো বেশিরভাগ ভগ্নপ্রায়। মহলগুলো পেরিয়ে এগিয়ে গেলে দেখবেন মন উদাস করা ঘাট বাঁধানো পুকুর। সমস্ত বাড়ি কিন্তু একবারে নির্মিত হয় নি, বরং বিভিন্ন সময় জমিদারির উত্তরাধিকার কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। বাহির মহলের উত্তরপাশে নাট্যশালা রয়েছে, যেখানে একসময় সাংস্কৃতিক চর্চা হতো। কাঠের রেলিঙের সৌন্দর্য, সুবিশাল নকশাযুক্ত গ্রীক শৈলীর পিলার, সিংহদুয়ার – সব মিলিয়ে আভিজাত্যের পরম অভিব্যক্তি। বাড়ির সিংহদুয়ারের বিপরীত দিকে আরেকটি বিশাল পুকুর, তার ওপারে মন্দির। বালিয়াটি জমিদার বাড়ির রাধাগোবিন্দ মন্দিরে এখনো পূজার্চনা হয়, দূর্গা পূজাও হয় প্রতি বছর। 


১৮৯৮ সালে রায়বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার রায়চৌধুরী জমিদারির অংশ হতে নারায়ণগঞ্জের বেশ কিছু জায়গা জমিদার রহিম বক্স হাজীর কাছে বিক্রয় করেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় জমিদারের বংশধরেরা ভারতে চলে যান। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বালিয়াটি জমিদার বাড়ির দায়িত্ব নেয় এবং বেশ ভালোভাবেই এ বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ করছে। 

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম দুই বার। প্রথমবার ২০১৯ সালে, পরেরবার গত সপ্তাহে। কপালফেরে দুই বারই গিয়েছি ভাদ্র মাসে। অতবড় মহলের বেশিরভাগ জানলা দরজা বন্ধ থাকায় বায়ু চলাচলের সুযোগ নেই। ফলে দুপুরের দিকে রোদ পেয়ে তেতে আগুন হয়ে যায় জায়গাটি। ফলে বুঝতেই পারছেন – গরম কাহাকে বলে আর কত প্রকার ও কি কি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তাই এসব জায়গায় গেলে নভেম্বর থেকে জানুয়ারী সবথেকে ভালো সময়। থ্যাঙ্ক মি লেটার 😀

তথ্যসূত্র:

১. বাংলার জমিদার ও রায়তের কথা, কমল চৌধুরী সম্পাদিত 

২. সরকারী তথ্য বাতায়ন 

৩. জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট (www.jnu.ac.bd)

৪. মেঘনাদ সাহা: জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের জনক, মুনির হাসান, কিশোরআলো, দৈনিক প্রথমআলো, ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

৫. ব্যক্তিগত ক্ষেত্রসমীক্ষা

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)