ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (২১ তম পর্ব)

|| পাথর স্তম্ভের খুঁটিনাটি ||

বাংলার ইতিহাস চর্চায় পাথরের নিদর্শনসমূহ একটি বিরাট স্থান দখল করে আছে। ইতিহাসের অজানা কতশত অধ্যায় লেখা আছে পাথরের শিলালেখগুলিতে। বাদাল স্তম্ভের মতো এসব শিলালেখ আবিষ্কার ও পাঠোদ্ধার না হলে আজ আমাদের ইতিহাস আলেখ্য অনেকাংশে অজানা থেকে যেত। আবার বাংলার অসংখ্য বিহার, মন্দির ও নগরীর ধ্বংসাবশেষে আমরা বিপুল সংখ্যক পাথরের স্তম্ভ দেখতে পাই। এসব পাথরের স্তম্ভের গায়ে খোদিত ইতিকথা না পাওয়া গেলেও ইতিহাসের নীরব সাক্ষ্য এসব পাথরখন্ড। 

জগদ্দল মহাবিহারের পাথরস্তম্ভ

প্রাচীন পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়), সোমপুর মহাবিহার, জগদ্দল মহাবিহার, মাহী সন্তোষ, পাথরঘাটা প্রভৃতি প্রত্নস্থান দেখতে গিয়ে ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পাথরের স্তম্ভগুলে দেখে অবাক হয়েছি। বিশেষ করে, জগদ্দল মহাবিহারে যত পাথর দেখেছি, আর কোন বিহারে এতটা দেখিনি। এর তুলনা কেবল মাহী সন্তোষ ও পাথরঘাটা হতে পারে। 

বাংলায় একটা বাগধারা প্রচলিত আছে "জগদ্দল পাথর", যার অর্থ গুরুভার। এ বাগধারার দুটি উৎস হতে পারে: ১. জগদ্দল মহাবিহার নির্মাণে বিপুল সংখ্যক পাথরের ব্যবহার একটি উপমায় দাঁড়িয়ে গেছে এবং ২. জগদ্দল মহাবিহার নির্মাণের ফলে এর আশেপাশের অনেকগুলো গ্রাম বিহারের ব্যয় নির্বাহে দান করা হয়। ফলে সেখানের বাসিন্দাদের জীবনে এটি একটি গুরুভার হয়ে দাঁড়ায়। কোন কারণটি সঠিক সেটি জানা দুঃসাধ্য। 




জগদ্দল মহাবিহারের পাথরস্তম্ভ

যাইহোক, বাংলায় এত সব পাথর এসেছে সুদূর রাজমহল থেকে নদীপথ হয়ে। গুপ্ত যুগের শেষভাগ ও পালযুগে এসব পাথর আনা হয়। সেন আমলে ও মুসলিম শাসনামলে নতুন করে পাথর আনা হয় নি, বরং পুরনো পাথরগুলো বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। মুর্শিদাবাদের নবাবগণ, বিশেষকরে মীর কাশিম পুরনো রাজধানী গৌড়ের প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ থেকে ভালো ইট ও পাথর সংগ্রহ করে তা নতুন রাজধানীর বিভিন্ন স্থাপনা নির্মানে ব্যবহারের উদ্যোগ নেন। এ কাজের ব্যয় নির্বাহে নবাবগণ নতুন আবওয়াব বা আবাব (অতিরিক্ত কর) প্রচলন করেন, যার নাম "কিম্মত খেস্ত গৌড়"। 

প্রত্নস্থলে মূলত দুই শ্রেণীর পাথরের স্তম্ভ পাওয়া যায়: ১. কোন অট্টালিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং ২. কোন অট্টালিকার সাথে সম্পর্কহীন। 

অট্টালিকার সাথে সম্পর্কশূণ্য পাথর-স্তম্ভগুলো বিজয়স্তম্ভ, স্মৃতিস্তম্ভ ও শিলালেখ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাদাল শিলালেখ, দিব্ব্যোক স্তম্ভ, অশোক স্তম্ভ ইত্যাদি। এ সকল স্তম্ভ একটি অখন্ড পাথর কেটে বানানো হত। এগুলোতে কারুকার্যের আধিক্য না থাকলেও এ সমস্ত স্তম্ভগুলো গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোন কোন স্তম্ভে গরুড় মূর্তি, নাগমূর্তি, সিংহমূর্তি খোদিত থাকে, যেগুলো বিভিন্ন অর্থবহ। আমি এর আগে দিব্ব্যোক স্তম্ভ ও বাদাল শিলালেখ নিয়ে লিখেছি।

বাদাল স্তম্ভ



দিব্ব্যোক স্তম্ভ

অট্টালিকার সাথে সম্পর্কযুক্ত পাথরস্তম্ভ আবার দুই প্রকারের: ১. ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত এবং ২. ভারবাহী স্তম্ভ বা মহাস্তম্ভ। 

প্রাচীন বিহার, মন্দির বা প্রাসাদের ভিত্তি হিসেবে চৌকোনা পাথর ব্যবহৃত হত। এগুলো আকারে ক্ষুদ্র হয়। এ পাথরগুলোয় প্রায়শ নকশা খোদাই করা হত না। আপনি পুরনো প্রত্নস্থানে এখনো অনেক পাথরখন্ড দেয়ালে প্রোথিত দেখতে পাবেন। এগুলো ভিত্তি পাথর। দরজার চৌকাঠ ও লিন্টেল হিসেবে ব্যবহৃত পাথরখন্ডও ভিত্তি পাথর, তবে এগুলোতে চমৎকার কারুকার্য দেখা যায়। মহাস্থানের খোদার পাথরভিটার পাথরটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।  

খোদার পাথর, মহাস্থানগড়


মাহী সন্তোষে পাথরস্তম্ভ

অট্টালিকার ভারবাহী স্তম্ভকে মহাস্তম্ভ বলা হয়। মৎসপুরাণে মহাস্তম্ভের প্রকারভেদ করা হয়েছে এভাবে:

রুচক শ্চতুরঃ স্যাত্তু অষ্টাস্রো বজ্র উচ্যত।
দ্বিবজ্রঃ ষোড়শাস্রস্ত দ্বাত্রিংশাস্র প্রলীনকঃ।
মধ্যপ্রদেশে ষঃ স্তম্ভো বৃত্তো ইতি স্মৃতঃ।।

অর্থাৎ, চারকোনা আকারের মহাস্তম্ভকে "রুচক", আটকোণ বিশিষ্ট মহাস্তম্ভ "বজ্র", ষোলকোণ "দ্বিবজ্র", বত্রিশকোণ "প্রলীনক" এবং গোলাকারকে "বৃত্ত" বলা হয়। মহাস্তম্ভের গোড়া বা পাদদেশকে "পীঠিকা" ও শীর্ষপ্রান্তকে "বোধিকা" বলা হয়। মহাস্তম্ভে নানারকম সৌন্দর্যবর্ধক কারুকার্য করা, বিশেষ করে বোধিকায় পদ্মফুল, ঘন্টা ও অন্যান্য নকশা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে মৎসপুরাণে। বাংলায় প্রাপ্ত পাথরস্তম্ভগুলো দেখে এটি সুস্পষ্ট যে, বাস্তুশাস্ত্র মেনে এসব পাথরস্তম্ভ ব্যবহৃত হত। 

সোমপুর মহাবিহারের পাথরস্তম্ভ


জগদ্দল মহাবিহারের পাথরস্তম্ভ


জগদ্দল মহাবিহারের পাথরস্তম্ভ

পাথরের স্তম্ভগুলো শতশত বছরের ইতিহাসের ভাঙাগড়ার সাক্ষী হয়ে আছে। বৌদ্ধবিহার থেকে পাথর সংগ্রহ করে সেন আমলে অনেক মন্দির হয়েছে। আবার মুসলিম আমলে মন্দির ও বিহার থেকে পাথর নিয়ে মসজিদ ও মাজারে ব্যবহৃত হয়েছে। আরো পরে, অনেক জমিদার বাড়িতে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকে পাথর সংগ্রহ করা হয়েছে। দিনাজপুর জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাণগড় থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল, যার অনেকগুলো এখনো রয়েছে। প্রাচীন মাজারে অনেক পাথরখন্ড দেখতে পাওয়া যায়, যা কোন প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে আনা হয়েছে; যেমন মহাস্থানে শাহ সুলতান বলখী (রঃ) মাজারে এমন অনেক পাথর দেখা যায়। অনেক পাথরখন্ড দেবতা হিসেবে পূজিত হওয়ার নজীর অনেক রয়েছে। অনেক পাথরকে ঘিরে নানা অলৌকিক লোকগাথা প্রচলিত আছে।

বাণগড়ের পাথরস্তম্ভ, উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া


প্রাচীন কারুকার্যময় পাথর, সম্ভবত মন্দিরের, রাজশাহী। ছবিটি প্রথমআলোর ওয়েবসাইট থেকে নেয়া

প্রত্নস্থানে পড়ে থাকা এসব পাথরখন্ডগুলো নিঃসন্দেহে আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষ্যবাহী। 

তথ্যসূত্র:

১. মৎসপুরাণ (২৫৫ অধ্যায়)
২. বরেন্দ্র খনন বিবরণ, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
৩. বঙ্গদেশের ভূম্যধিকারী ও প্রজাসংক্রান্ত আইনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সাতকড়ি হালদার
৪. ব্যক্তিগত ক্ষেত্রসমীক্ষা 

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)