সত্যপীর বা সত্যনারায়নের সুলুকসন্ধানে (১ম পর্ব: প্রাককথন)

(সত্যপীরের ভিটা, সোমপুর মহাবিহার, নওগাঁ, বাংলাদেশ)

এক.

মূল লেখাটির আগে এ লেখার পটভূমিটি জানানো দরকার। গত জুন মাসে আমি সহসাই করোনা আক্রান্ত হয়ে বেশ কাহিল হয়ে গিয়েছি। বড় দাদা শ্রদ্ধেয় ডাঃ অমিত দে ওপার বাংলা থেকে সবসময় খোঁজ নিয়ে সাহস দিয়ে চলেছেন। আমাকে চাঙা রাখার জন্য ইতিহাসের নানা খবরাখবর দিয়ে মনোযোগ ব্যাধি থেকে সরিয়ে রাখছেন। এমনই একদিন হঠাৎ অমিতদা পাঠালেন এক বনেদী বাড়ির ছবি, যেখানে একটি হিন্দু জমিদার পরিবার কয়েক পুরুষ ধরে এখনো দূর্গা পূজার সময় মুসলমান ফকিরদের খাওয়ানোর একটি প্রথা পালন করে চলেছেন। পরিবারটির ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ বংশের কোন এক পূর্বপুরুষ একজন মুসলমান ফকির বাবার আশির্বাদে ব্যবসায় উন্নতি করে জমিদারি প্রাপ্ত হন। সেই থেকে আজো দূর্গা পূজার এক বিশেষ দিনে ফকিরবাবার মাজারে শিরনি দিয়ে ফকিরদের খাওয়ানো হয়। সঙ্গত কারণেই পরিবারটির নামধাম অপ্রকাশিত রাখা হল। গল্পের প্রসঙ্গে চলে এলো হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির কথা, যেটি দিনদিন কর্পূরের মতে উবে যাচ্ছে। তখনই খেয়াল আসলো সত্যপীরের কথাটি। অমিতদাও ভীষণ উৎসাহ দিলেন কিছু লেখার জন্য। মজে গেলাম বিষয়টি নিয়ে, ভাবলাম সুস্থ হলে কিছু লিখবো। পাঠকের নিতান্তই মন্দ ভাগ্য, সুস্থ হয়ে উঠলাম আর লেখাটিও শুরু করে দিলাম। অমিতদার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ লেখাটির কথা মনে ধরিয়ে দেয়ার জন্য। ভালোমন্দ পাঠকের হাতে সমর্পিত।

মধ্যযুগে মুসলমান আগমনের সময় থেকে পরের মোটামুটি একশো বছর সময়কাল বড় টালমাটাল। নতুন ধর্মের পতাকা নিয়ে নতুন জাতিগোষ্ঠী বাংলায়। ক্ষমতার লড়াইয়ের পাশাপাশি সংঘাত সর্বত্র – ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য সব জায়গায় এর ছাপ সুগভীর। প্রথমদিকে সংঘাতটি বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমান এ তিনপক্ষের হলেও বৌদ্ধধর্মের বিলোপের ফলে সংঘাতটা হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে এসে দাঁড়ালো। প্রথমদিকে বিজেতা মুসলমানরা তরবারি দিয়ে বিজিত মানুষদের ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা করতে থাকলো। কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য এলেও সেটি ছিল বেশ নগন্য। সে তুলনায় মুসলিম শাসকদের পথ ধরে এ বাংলায় আগত সুফিগণ ইসলাম প্রচারে অনেক বেশি সফল হয়। এর প্রধান কারণ সুফিগণের উদারতা প্রদর্শন ও সমাজের সকল স্তরের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়া। বিজেতা মুসলমান শাসকগণ প্রথমদিকে ধর্মীয় গোঁড়ামির বশবর্তী হয়ে বিজিতদের মনস্তাত্ত্বিকতা বোঝার কোন চেষ্টা করেনি, কেবল বলপ্রয়োগ করেছিল। সেদিক থেকে সুফিগণ এ দেশের মানুষের সাথে উদারপন্থা অবলম্বন করে মিশে যান। অপরদিকে সুফিগণের হাত ধরে বাংলায় আসে ইসলামের "সুফিবাদ" যা হিন্দুধর্মের অদ্বৈতবাদ ও বৌদ্ধদের শূন্যবাদের সাথে প্রচুর সাদৃশ্যপূর্ণ, যদিও এদের মধ্যে অনেক বিষয়ে প্রচুর অমিলও রয়েছে। যাইহোক, সুফিগণের এমন উদার আচরণ, সকল স্তরের মানুষের সমান অধিকার প্রদান করা এবং সর্বোপরি সুফিবাদের প্রেমময় আহ্বানের ফলে নিম্নবর্গের হিন্দুগণ ও বিপন্ন বৌদ্ধরা অনেকেই ধর্মান্তরিত হতে থাকে।

এদিকে অনেকদিনের সহাবস্থানের ফলে দুটি আলাদা ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মে মিথস্ক্রিয়ার ফলে একে অপরকে প্রভাবিত করলো এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের আদান-প্রদান ঘটলো। সাধারণ জনগণ বুঝে গেল, রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাঁধলে উলুখাগড়ার প্রাণান্ত। ক্ষমতার জন্য শাসকশ্রেণী লড়াইয়ে নিয়োজিত থাকলেও সাধারণ মানুষের এতে কোন উপকার হয় না, বরং নানারূপ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ফলে নিজেরা সম্প্রীতি ও সদ্ভাব নিয়ে বসবাস করা জরুরী। এই তাগিদ থেকেই  এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের আদান-প্রদানের ফলে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের অনেক আচার ও বিশ্বাস একে অপরের সাথে মিশে গেল। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলায় হিন্দুদের লৌকিক দেবদেবী মুসলিম রূপ ধরে মুসলমান সমাজে স্থান নিলেন এবং মুসলমানদের পীরগণ দেবতার মতো পূজা পেলেন হিন্দু সমাজে। এভাবেই হিন্দুদেবী বনদূর্গা ঘাগড়া ও পাজামা পরিধান করে মুসলমান সমাজে হয়ে গেলেন বনবিবি, সপ্তমাতৃকা হলেন সাতবিবি। অপরদিকে মানিকপীর, বড় খাঁ গাজী, পীর গোরাচাঁদ, মাদার পীর হিন্দুদের কাছে দেবতাজ্ঞানে শিরণি পেতে থাকলেন। ধর্মীয় ভাবধারার এ বিনিময় বহু বছরের সহাবস্থানের ফলেই কেবল সম্ভব হয়েছে। আমাদের আলোচ্য সত্যনারায়ন বা সত্যপীরের উদ্ভব ও হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তিও ঠিক এভাবেই হয়েছে।

আমরা সত্যপীর নিয়ে কথা শুরুর আগে আরো কয়েকটি বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করবো। এখন ইসলামে পীরবাদের বিষয়ে দু'একটা কথা বলা প্রয়োজন। 

ইসলাম ধর্মের মূল দুইটি ধারা হলো শরিয়ত ও মারেফাত। শরিয়ত ধারায় একজন মুসলমানের লক্ষ্য পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামের ফরজ (অবশ্য পালনীয়) কাজগুলো – নামাজ, রোজা, হজ্ব ইত্যাদি পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভ। শরিয়তের পরের ধাপ হলো মারেফাত (তাসাওউফ)। এ ধারায় একজন সুফিসাধক শরিয়ত মতে নামাজ-রোজা পালন ছাড়াও যিকির (স্মরণ), মোরাকাবা (ধ্যান) প্রভৃতির মাধ্যমে নিজের 'আমিত্ব' এর বিলোপ ঘটিয়ে পরমসত্ত্বার সাথে বিলীন হয়ে পরম পরিতৃপ্তি লাভ করেন। সুফি সাধকগণ মূলত সুদীর্ঘ ও সুকঠিন শরিয়ত, তরিকত, মারেফাত ও হকিকত - এ চারটি স্তর অতিক্রম করে তবেই মহান আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্য লাভ করেন। 

শরিয়ত পন্থায় একজন সাধক পাঁচটি ফরজ (অবশ্য পালনীয় কাজ) কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত পালনের মাধ্যমে পরের স্তরে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। শরিয়ত হলো কোরআন ও হাদিসের আলোকে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। শরীয়তের নিয়মাবলী পালনের মধ্য দিয়ে সাধক তরিকত স্তরে পৌঁছায়। তরিকত স্তরে সাধককে কোন পীর বা মুর্শিদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে হয়। এ ব্যবস্থায় সাধককে ঐ পীরের মুরিদ নামে অভিহিত করা হয়। পীর মুরিদকে পথ দেখায়, যে পথে চলে সাধক পরের স্তরে পৌঁছানোর যোগ্যতা অর্জন করে। এ স্তরে শরিয়তের বিধান পালনের পাশাপাশি আরো অনেকগুলো অভ্যাস পালন করে সাধক পরের স্তরের জন্য প্রস্তুত হয়। পরের দুটি স্তর হলো যথাক্রমে মারেফাত ও হকিকত। এ স্তরদুটিতে সাধক নিজের আমিত্বকে বিলীন করে দিয়ে পরমসত্ত্বায় লীন হয়ে যায়। সুফি সাধকের এ উচ্চতর পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সুকঠিন এবং গুঢ় জ্ঞান হওয়ায় এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জনসাধারণে আলোচনাও অনুচিত। 

মারেফাত তথা সুফিবাদ বা সুফিতত্ত্বের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ইসলাম ধর্মের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে। পবিত্র কুরআনের আধ্যাত্মিক শিক্ষা সুফিবাদের মূলভিত্তি। অনেক মনীষী মত দিয়েছেন যে, সুফিবাদের সমস্ত জ্ঞান হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) জানতেন এবং তাঁর কাছ থেকে হযরত আলী (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবীগণ এ জ্ঞান লাভ করেন। এ বিষয়ের প্রামাণিক দলিল হিসেবে একটি উদাহরণ দেয়া যায়, সুফিবাদের পথে ক্বলব সংশোধন (অন্তর পরিশুদ্ধি) প্রধানতম সিঁড়ির একটি। পবিত্র কোরআনে ১২৪ টি আয়াত এবং মহানবী (সাঃ) এর ১৪০ টি হাদিস রয়েছে যেগুলোতে  সুস্পষ্টভাবে ক্বলব সংশোধন নিয়ে বলা হয়েছে। এভাবে সুফিবাদের প্রতিটি মূলনীতি নিয়ে পবিত্র কুরআন প্রচুর আয়াত ও মহানবী (সাঃ) এর হাদিস বিদ্যমান। আরবে জন্ম নেয়া সুফিবাদ ভারতে প্রবেশ করে ইরানের মধ্য দিয়ে এ দেশে আগত সুফিগণের হাত ধরে। 


দুই.

"The Sufi is one who does what others do – when it is necessary. He is also one who does what others cannot do – when it is indicated." – Nuri Mojudi

সুফি কারা? এ নিয়ে নানা মতামত পাওয়া যায়। একদল গবেষক মনে করেন, সুফি শব্দটি আরবী "স্বফা" ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ পবিত্রতা। সুফিরা অন্তর ও বাহিরের সামগ্রিক পবিত্রতা রক্ষা করে চলেন বলে তাঁদের সুফি বলা হয়। আরেকটি দল বলছেন, আরবী "অহলু-স্ব-স্বুফফহ" কথা থেকে সুফি নামের উদ্ভব, যার অর্থ পর্য্যোঙ্কোপবিষ্ট। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যে সকল মুসলমান সাধুব্যক্তি মসজিদের বাইরে আসনে বসে মানুষকে ইসলামের পথে আহ্বান করতেন এবং ধর্মপ্রাণ মানুষের দেয়া দান গ্রহন করে জীবনধারণ করতেন, তাঁরাই সুফি। অনেকে মনে করেন গ্রীক শব্দ "Philosophos" এর আরবী অপভ্রংশ "ফয়লসুফ" থেকে সুফি নামের উদ্ভব; যেহেতু সুফিগণ ইসলামের দার্শনিক দিকের চর্চা করেন। তবে এখন পর্যন্ত সর্বাধিক গবেষক কর্তৃক গৃহীত মত হলো, আরবী শব্দ "স্বূফ" থেকে সুফি শব্দের উদ্ভব, যার অর্থ বিশুদ্ধ পশম। ইসলামের সূচনালগ্নে ইসলামে দীক্ষিত ব্যক্তিদের অনেকেই খুব সাধারণভাবে জীবনধারণ করতেন। এঁরা পোশাকের আড়ম্বরতা ত্যাগ করে পশমের দীর্ঘ পোশাক পরতেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রাঃ) নিজেও পশমের লম্বা পোশাক (জুব্বাহ) পরিধান করতেন এবং খুব অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। অন্যান্য খলিফাগণও এমনই ছিলেন। যখন ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকলো এবং সাম্রাজ্য বাড়তে থাকলো, বিলাসিতা ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের প্রতি অনেকে ধাবিত হল। এসময় এক গোষ্ঠী মানুষ এসব বিলাসিতা ত্যাগ করে সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে লাগলেন এবং আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হলেন। এঁরাই সুফি বলে আখ্যাত। পশমের পোশাক পরিধান ও পরিশুদ্ধভাবে জীবনযাপনের জন্য তাঁদের সুফি বলা হয়।

ইসলামের সূচনালগ্নে সুফিবাদের জন্ম এ বিষয়ে আরো দু'একটা কথা বলা যায়। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে সুফিবাদ নিয়ে যে অসংখ্য মাহাত্ম্যপূর্ণ আয়াত রয়েছে, সে কথা আমি এর আগেও উল্লেখ করেছি। একটি বিশেষ সুরার কথা উল্লেখ করা যায়, সেটি হল সুরা কাহফ। এ সুরা অনেকগুলো কারণে বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ। এ সুরা থেকে হযরত খিজির (আঃ) এর কথা জানা যায়, যাঁকে সুফিবাদে একজন প্রবাদপুরুষ বলা হয়। সুফিবাদে খিজির (আঃ) এর উপস্থিতি বহুল আলোচিত। সুরা কাহফ এ বলা হয়েছে:

"অতঃপর তাঁরা আমার বান্দাদের মধ্যে এমন একজনের সাক্ষাত পেল, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে অনুগ্রহ করেছিলাম, আর আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান" [সুরা কাহফ, আয়াত ৬৫]

এখানে খিজির (আঃ) এর কথা বলা হয়েছে।  খিজির (আঃ) আল্লাহ তায়ালার হুকুমে আবে হায়াত (Spring of Life) এর পানি পান করে দীর্ঘ আয়ু লাভ করেন এবং ইনি আজো জীবিত আছেন বলে অসংখ্য প্রখ্যাত ইসলামী গবেষকগণ মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁরা কতিপয় হাদিসের দলিল উপস্থাপন করেন। সে বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। এখানে উপরোক্ত বিষয়টির অবতারণা কেবলমাত্র এটি বুঝানোর জন্য যে, পারস্য নয় - ইসলামের শুরুতেই সুফিবাদের জন্ম হয়েছে আরবে। 

বাংলায় আগত পীরদের অনেকেই হযরত খিজির (আঃ) এর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এবং তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছেন বলে পুঁথি, পাঁচালী ও গ্রন্থাবলীতে পাওয়া যায়। আমাদের আলোচ্য সত্যপীরও এঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এঁনাকে নিয়ে লিখলে আলাদা সুবিশাল লেখা হয়ে যাবে। যাইহোক, খিজির (আঃ) মাঝিদের নৌকা এক অত্যাচারী বাদশাহের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। 

"নৌকাটির ব্যাপারে–সেটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষন করত। আমি ইচ্ছা করলাম যে, সেটিকে ক্রটিযুক্ত করে দেই। তাদের অপরদিকে ছিল এক বাদশাহ। সে বলপ্রয়োগে প্রত্যেকটি নৌকা ছিনিয়ে নিত।" [সুরা কাহফ, আয়াত ৮০]

সে কারণে আজো মাঝিরা নৌযাত্রার সময় "বদর বদর" বা খোয়াজ খিজির বা বদরপীরের নাম নেয়। মূলত খিজির (আঃ) কে এরূপ নামকরণ করা হয়েছে লৌকিক বিশ্বাসে। বদর বলতে চাঁদকে বুঝানো হয়, এমন ধারণা অনেকে করেন, যেটি মূলত ভ্রান্ত।

বদর বদর বলি,
কিনারে কিনারে চলি,
ভাটি গাঙে ভাটিয়ালি গাহিও।

সুফিবাদে যাঁরা প্রাতঃস্মরণীয় হাসান আল বসরী (রাঃ), হযরত আবু হাশিম আল-মক্কী (রাঃ), হযরত রাবিয়া আল-বসরী (রাঃ) প্রমুখ সবাই পারস্য-প্রভাবের পূর্বের সুফিসাধক, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ইসলাম যতই পারস্য, সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি দিকে দিকে ছড়িয়ে যেতে থাকলো, সেসব অঞ্চলের নানা লৌকিকতা ও সংস্কৃতির প্রভাব সুফিবাদে মিশ্রিত হতে লাগলো। এ ক্ষেত্রে পারস্যের অবদান সবচেয়ে বেশি। পারস্যে এসেই সুফিবাদের ইশক (প্রেমময়) সাধনপথে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হতে লাগলো। এক্ষেত্রে সবার আগে যাঁদের নাম স্মরণ করতে হয়, জালালুদ্দিন রুমি (রঃ) তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচিত মসনভী শরিফের প্রভাব কেবই ইসলামের সুফিবাদই নয়, অন্যান্য ধর্মের মরমীধারাকে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। সুফিবাদে ইশকের যে ফল্গুধারা আজো বহমান রয়েছে সেথায় তাঁর অবদান অনন্য। রুমি বলছেন:

হরকেরা জামা জে ইশকে চাকে শোদ,
উ জে হেরচো আয়েবে কুল্লি পাকে শোদ।

যে ব্যক্তির অন্তর খোদার মহব্বতে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে, তার অন্তঃকরণ হতে পার্থিব বস্তুর ভালোবাসা দূর হয়ে গিয়েছে। তিনিই প্রকৃত কামেল হতে পেরেছেন। 

তবে পারস্য হয়ে সুফিবাদ যখন আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে ভারতে পৌঁছে গেল, তখন এতে নতুন কিছু মাত্রা যোগ হল। 


(খাজা মইনুদ্দীন চিশতীর মধ্যবয়সের একটি চিত্র। উইকিপিডিয়া থেকে গৃহীত)

তিন.

"Allah enundated my knowledge with me from my heart. He drew me near to Him after I had been so far from Him. He made me His intimate and chose me."

– Mansur Al-Hallaj 

ইসলামপূর্ব এ বিশাল ভূখন্ডে ছিল বৌদ্ধদের অবাধ বিচরণ। বোখারা, সমরকন্দ, তুর্কিস্থান, পারস্য, আফগানিস্তান প্রভৃতির এ সুবিশাল অঞ্চলের বৌদ্ধধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমানগণ পূর্বসংস্কার সম্পূর্ণ পরিত্যাগ না করে বৌদ্ধধর্মের কিছু আচার-বিশ্বাস ইসলামে আমদানি করে, বিশেষত সুফিবাদে। যেহেতু ইসলামের সুফিবাদ ও বৌদ্ধদের শূন্যবাদে কিছু সাদৃশ্য রয়েছে, বৌদ্ধধর্মের প্রভাব এ সময় সুফিবাদে বেশি পড়েছে। আর এভাবেই একাদশ–দ্বাদশ শতকে  সুফিবাদে জন্ম নেয় "পীরবাদ"। ড. মুহম্মদ এনামুল হক পীরবাদকে সুফিবাদের "কুপুত্র" বলে অভিহিত করেছেন। মূল সুফিবাদ, তথা ইসলাম থেকে "পীরবাদ" অনেক দূরে সরে গিয়েছে। এর ফলে সুফিবাদ যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে; যেহেতু জনসাধারণ পীরবাদকেই সুফিবাদ বলে ধরে নিয়ে এটিকে ইসলাম পরিপন্থী বলে অভিহিত করে। 

বৌদ্ধধর্মে "থেরবাদ" এর "থের" কথাটির অনুরূপ ফারসি শব্দ হলো "পীর"। অর্থগতভাবে দুটি শব্দই স্থিতধী অথবা জ্ঞানী ও বৃদ্ধ ব্যক্তি বুঝায়। 

বৌদ্ধদের বিশ্বাস "থের" একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সিদ্ধ ব্যক্তি। এ কারণে থেরগণ দেহত্যাগ করলে তাঁদের মৃতদেহ দাহ করার পর দেহভস্ম সংরক্ষণ করা হতো সমাধি বা চৈত্য নির্মাণ করে। মৃতদেহ দাহ করার স্থানকে বলা হয় "চিতা"। এই "চিতা" কথাটি থেকে "চৈত্য" কথাটি এসেছে বলে অনেক গবেষক মত দিয়েছেন। বিপদ-আপদে, মনস্কামনা পূরণে থেরগণের সমাধি বা চৈত্য এর নিকট একা বা সমবেতভাবে পূজা ও শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা বৌদ্ধদের প্রাচীন একটি প্রথা। চৈত্য ও স্তুপ প্রায় সমার্থক হলেও কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। চৈত্যের ভেতরে স্তুপ স্থাপন করা হতো। মূলত দেহাবশেষ এই স্তুপের ভেতরে রাখা হতো। স্তুপ তিন প্রকারের:

১. শরীর ধাতু স্তূপ বা শারীরিক স্তূপ: এ শ্রেণীর স্তূপে বুদ্ধদেবের এবং তাঁর অনুগামী ও শিষ্যবর্গের দেহাবশেষ রক্ষিত ও পূজিত হতো।

২. পারিভৌগিক ধাতু স্তূপ বা পারিভৌগিক স্তূপ: এ শ্রেণীর স্তূপে বুদ্ধদেব কর্তৃক ব্যবহূত দ্রব্যাদি রক্ষিত ও পূজিত হতো।

৩. নির্দেশিক বা উদ্দেশিক স্তূপ: বুদ্ধ ও বুদ্ধধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোন স্থান বা ঘটনাকে উদ্দেশ্য করে বা চিহ্নিত করার জন্য নির্মিত স্তূপ।

এ সকল স্তুপে ধূপ-দীপ-চন্দন-ফুলসহ নানা উপচারে পূজা নিবেদন করা হতো। অনেক সময় ছোট ছোট নিবেদন স্তুপ নির্মাণ করতো ভক্তবৃন্দ মানত পূরণ ও ভক্তি নিবেদনের অংশ হিসেবে। যখন পারস্য, বোখারা, সমরকন্দসহ এ বিশাল ভূখন্ডেের বৌদ্ধরা ইসলামের সংস্পর্শে আসে এবং কখনো বলপ্রয়োগের ফলে, আবার কখনো নানা উপায়ে তারা ইসলাম গ্রহন করলো, অনেক বছর পরেও তাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন সম্পূর্ণ হয় নি। এর ফলে এ বিশাল জনগোষ্ঠী মূল ইসলামের সাথে তাদের পূর্বলালিত সংস্কারগুলো মিশিয়ে ফেললো। এর ফলে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হলো সুফিবাদ। 

মূল সুফিবাদ যেখানে আল্লাহ তায়ালার সাথে কোন প্রকার শরিকী অনুমোদন করে নি এবং কোরআন ও হাদিসকে পথনির্দেশক বলে মেনেছে; সেখানে সদ্যজাত পীরবাদ শিরকের সূচনা করলো। ইসলামে "শিরক" সবচেয়ে গর্হিত অপরাধের একটি এবং শিরকের বিপক্ষে কঠোর অনুশাসন দেয়া আছে। শিরক অর্থ আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো ইবাদত (উপাসনা) করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে সিজদাহ্ (শ্রদ্ধা নিবেদন) করা। ইসলামে এরূপ কাজকে অত্যন্ত গর্হিত বলা হয়। মূল সুফিবাদের সমস্ত সাধক আজীবন আল্লাহর ধ্যান (মোরাকাবা) করেছেন তাঁকেই কেবল পাওয়ার জন্য।  অথচ পীরবাদে অনুসৃত আচার আচরনে পীরকে তুষ্ট করতে যেরকম কাজকর্ম করা হয়, এমনকি পীরের মাজারে সিজদাহ্ দেওয়ার মতো প্রথাও দেখা যায়, সেটি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে যত মাজার পরিলক্ষিত হয়, আর অন্য কোথাও তেমনটি নেই। এমনকি মদিনায় মহানবী (সাঃ) এর রওজা মোবারকে অনেক কঠোরভাবে বিধিনিষেধ মানা হয়, যাতে কেউ শিরক না করে। অথচ ভারতে আগত সুফিদের মৃত্যুর পর গড়ে উঠতে থাকে বিশাল বিশাল মাজার এবং অনেকটা ব্যবসায়িক মনোভাব পরিলক্ষিত হয় এ সমস্ত জায়গায়। নানা রকম বুজরুকি কান্ড দেখিয়ে সাধারণ মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের সুযোগ নেওয়া হয়। ফলে বিশুদ্ধবাদী শরিয়তপন্থী মুসলমানরা পীরবাদের বিপক্ষে কথা বলতে থাকে এবং সেই সাথে সুফিবাদের প্রকৃত কথা বিকৃতভাবে প্রচার করা হতে থাকে।

বৌদ্ধদের তিন প্রকারের অনুরূপ তিন রকমের মাজার পরিলক্ষিত হয়:

১. যেখানে কোন পীরের মৃতদের সমাহিত করা হয়েছে। 

২. যেখানে পীর জীবিতাবস্থায় কিছু সময় কাটিয়েছেন এবং তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র রয়েছে। 

৩. কোন পীরের স্মরণে নির্মিত খানকাহ 

আবার বৌদ্ধদের "চৈত্য-পূজা"র মতোই এসব মাজারে আগরবাতি, মোমবাতি ও সুগন্ধির ব্যবহার করে "পীর-পূজা" প্রচলিত। এদিকে পীর-মুরিদ ধারণাটি ভারতে প্রচলিত গুরু-শিষ্য পরম্পরার অনুরূপ। এভাবেই একাদশ-দ্বাদশ শতকে পারস্য হয়ে বিশাল ভূখন্ড পেরিয়ে পীরবাদ বাংলায় এসে পৌঁছায় এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। সুলতানী ও মোঘল আমলে পীরপ্রথা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে ব্যাপক হারে। বাংলায় প্রচুর জমি "পীরপাল" বা পীরোত্তর করা হয়। বৃটিশ আমলে ক্ষমতাচ্যুত মুসলিম সমাজে এ সমস্ত কুপ্রথা আরো শক্ত হয়ে গেড়ে বসে। ভাগ্যাহত মুসলমানরা সুদিন ফেরাতে অলৌকিক ও বুজরুকি ক্ষমতার দিকে আকৃষ্ট হয়, যা পীরপ্রথার প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় করে। 

উপরোক্ত বিষয় থেকে একটি বিষয় অনেকটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, কেন সুফিবাদ ইসলামের মূলধারা থেকে দূরে এমনটা বলা হয়। তবে উপরোক্ত কারণ শুধু নয়, নানা রাজনৈতিক কূটকচাল ও ক্ষমতার লড়াইও এর পেছনে রয়েছে। কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থপরতার বলি হয়েছেন মনসুর হাল্লাজের অনেক সুফি সাধক। অবশ্যই এসব গোষ্ঠী ইসলামের মূল বাণী থেকে সরে গিয়ে বিলাসিতা ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শাসক বনে গিয়েছিল। মূল বিষয়বস্তুর কারণে এটি নিয়ে আর বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না।

আমাদের প্রাককথনের মূল উদ্দেশ্য সুফিবাদ ও পীরবাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরী করা। এটি "সত্যপীর" নিয়ে আলোচনায় যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। আশা করি, পাঠকগণও এ বিষয়ে আমার সাথে সহমত হবেন। পরের পর্ব থেকে আমরা সত্যপীর নিয়ে অনেক কথা বলবো। 


গ্রন্থপঞ্জি:

১. বঙ্গে স্বূফী প্রভাব, ড. এনামুল হক
২. বঙ্গে সুফি প্রভাব ও সুফিতত্ত্বের ক্রমবিকাশ, প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য 
৩. বাংলার পীর সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ওয়াকিল আহমদ
৪. ক্বলব সংশোধন, মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আলী 
৫. ইমাম বাতায়ন, বাংলাদেশ 
৬. Mystical Dimensions of Islam, Annemarir Schimmel
৭. মসনভী শরিফ, হযরত মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রঃ) 
৮. বাংলার সুফি সাহিত্য, আহমদ শরীফ
৯. Tawasin of Mansur Al-Hallaj, Translated by Aisha Abd Ar-Rahman At-Tarjumana
১০. বাঙালির ইতিহাস (আদি পর্ব), নীহাররঞ্জন রায়

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)