ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (২৩ তম পর্ব)

|| পুণ্ড্রে বুদ্ধের পদার্পণ ও গোকুল মেধ ||


শ্রাবস্তী নগরের বাসিন্দা অনাথপিণ্ডদ, বুদ্ধের একনিষ্ঠ ভক্ত। তথাগতের আশির্বাদে ভক্তিমতি ও পরমা সুন্দরী কন্যা তাঁর ঘর আলো করে আছে। কন্যা সুমাগধা। কন্যা সুমগধার বিয়ের অনুমতি প্রার্থনা করে বুদ্ধের নিকট উপস্থিত অনাথপিণ্ডদ। পাত্র পুণ্ড্রনগর নিবাসী সার্থনাথের পুত্র বৃষভদত্ত। ভক্তের নিবেদন শুনে স্মিতহাস্যে বুদ্ধ অনুমতি প্রদান করলেন। বিবাহ সুসম্পন্ন হলো। 

পুণ্ড্রনগরে নিজ শ্বশুরালয়ে শুভ প্রবেশ হলো নববধু সুমাগধার। কয়েকদিন পরে সাধুসন্তদের নিমন্ত্রণ করলেন সার্থনাথ। পরম পূজ্য জিন (জৈনধর্মের প্রবর্তক)-কে সবিনয়ে নিমন্ত্রণ করলেন নববধূকে আশীষ প্রদানের জন্য। পূজোপকরণ নিয়ে সুমাগধা প্রস্তুত হলেন। মুণ্ডিতমস্তক ও নগ্ন জৈন সাধুদের নিজ আলয়ে দেখে লজ্জিত হলেন সুমাগধা। লজ্জায় নিজ মুখ বস্ত্রাচ্ছাদিত করে সুমাগধা শ্বশুরকে বললেন, "ছিঃ ছিঃ! দিগম্বরগণের সম্মুখে কুলবধুগণ রহিয়াছেন, এইরূপ আচার এই প্রথম দেখিলাম। এই শৃঙ্গহীন পশুগণ আপনাদের গৃহে ভোজন করিতেছে। ইহারা মনুষ্য নহে, সম্ভবতঃ এই মনে করিয়াই বুঝি অঙ্গনাগণ ইহাদের দেখিয়া লজ্জিত হন না।"

পুত্রবধুর মুখে জৈন সাধুদের নিন্দা শুনে মর্মাহত হলেন শ্বশুর সার্থনাথ। জানতে চাইলেন শ্রাবস্তীতে কিরূপ ধর্মাচরণ করা হয়। বুদ্ধের ভক্ত সুমাগধা বিস্তারিত বর্ণনা করলেন ভগবান তথাগতের মহিমা। বুদ্ধের সমস্ত মহিমা শ্রবণ করে সার্থনাথ বুদ্ধের দর্শন ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। 

সুমাগধা ভক্তিভরে বুদ্ধকে স্মরণ করলেন এবং আমন্ত্রণ জানালেন তাঁকে পুণ্ড্রে পদধূলি দেওয়ার জন্য। ত্রিকালদর্শী বুদ্ধ শুনলেন ভক্তের আবাহন। 

তথাগত আনন্দকে ডেকে বললেন সমস্ত বৃত্তান্ত। জানালেন নিজের সিদ্ধান্তের কথা। পুণ্ড্রনগরে যেতে হবে। এবং যেতে হবে কাল সকালেই। যেহেতু পুণ্ড্র বহুদূরের পথ, তাই যেতে হবে আকাশমার্গে। তাই বুদ্ধের নির্দেশে সিদ্ধপ্রাপ্ত বারোজন ভিক্ষু নির্বাচিত হলেন তাঁর সাথে পুণ্ড্রনগরে যাওয়ার জন্য। 

পরদিন ভোরে আকাশমার্গ দিয়ে ভিক্ষুগণ আসতে লাগলেন একে একে। সার্থনাথ সুমাগধাকে একজন তেজস্বী বৌদ্ধ ভিক্ষু আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ইনি বুদ্ধ কিনা। সুমাগধা জানালেন, "ইনি ভিক্ষু অজ্ঞাত কৌণ্ডিল্য"। এভাবে একজন এজকন করে দ্বাদশ ভিক্ষু উপস্থিত হলেন। এঁরা হলেন, অজ্ঞাত কৌণ্ডিল্য, মহাকাশ্যপ ভিক্ষু, ভিক্ষু শারিপুত্র, মৌদ্গল্য ভিক্ষু, ভিক্ষু অনিরুদ্ধ, ভিক্ষু সুপূর্ণ, ভিক্ষু এষ্যজিৎ, ভিক্ষু উপালী, ভিক্ষু কাত্যায়ন, ভিক্ষু কৌষ্টিল, ভিক্ষু পিলিন্দ বৎস এবং ভিক্ষু শ্রোণকোটি। সমস্ত পুণ্যাত্মার জ্যোতিতে চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠল। অবশেষে সমস্ত পুণ্ড্রনগর আলোকিত করে এক পবিত্র সুবাসে বাতাস পরিপূর্ণ অষ্টাদশ মূর্তি ধারণ করে উপস্থিত হলেন বুদ্ধ। এমন অনিন্দ্য রূপ দেখে ভক্তিভরে মস্তক অবনত করলেন সার্থনাথ ও সমস্ত পুণ্ড্রনগর। তথাগতের সুমধুর উপদেশ বাণী শুনে ধন্য হলো পুণ্ড্রবর্ধন।

এভাবেই পুণ্ড্রে প্রচার হলো বৌদ্ধধর্ম। করতোয়া বিধৌত পত্রোর্ণ (রেশম), নাগকেশর, পনস্ (কাঁঠাল) এর ভূমি পুণ্ড্রবর্ধন শ্রদ্ধাবনত চিত্তে গ্রহন করলো তথাগতের বাণী, তাঁর আদর্শ। 

ভগবান বুদ্ধ পুণ্ড্রে তিনমাস অবস্থান করেছিলেন পারিষদবর্গ নিয়ে। সম্রাট অশোক বুদ্ধ যেখানে বসে উপদেশ দিয়েছিলেন, সেখানে নির্মাণ করেছিলেন সুবিশাল একটি স্তুপ। পুণ্ড্রনগর থেকে প্রায় আড়াই মাইল পশ্চিমে এ স্তুপটি অবস্থিত বলে হিউয়েন সাং উল্লেখ করেছিলেন। 

বর্তমান মহাস্থানগড় (পুন্ড্রনগর) থেকে ৪ কি:মি: দক্ষিণ-পশ্চিমে গোকুল ইউনিয়নের গোকুল, রামশহর ও পলাশবাড়ি মৌজার সংযোগস্থলে একটি আশ্চর্যময় প্রত্নস্থান চোখে পড়ে। গোকুল মেধ নামে খ্যাত এ স্থানটিকে মানুষ বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বলে চেনে। গবেষকগণ এটিকে বলেন, পুণ্ড্রের পর্যবেক্ষণ চৌকি অথবা বৌদ্ধ সংঘারাম। অথচ অশোকের সেই সুবিশাল মাহাত্ম্যপূর্ণ স্তুপটির কথা সবাই বিস্মৃত। আমার মতে, অশোকের সেই স্তুপটি হলো এই গোকুল মেধ।

১৯৩৪ - ৩৫ এবং ১৯৩৫ - ৩৬ অর্থবছরে গোকুল মেধে খননকার্য পরিচালনা করা হয়। এসময় কাদামাটিতে গাঁথা ইট নির্মিত এমন একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ বেরিয়ে আসে যেটি মূলত দুটি অংশে বিভক্ত। নিচের অংশ মঞ্চ এবং ওপরের অংশ মন্দির। এখানে দুটি পুনর্নিমাণসহ একটি মূল নির্মাণামলের চিহ্ন পাওয়া যায়। 

দৈর্ঘ্যে ৭২ মিটার ও প্রস্থে ৫০ মিটার আয়তনের এই স্থাপনাটিতে পাওয়া গেছে ১৭২ টি কুঠুরি বা প্রকোষ্ঠ। সবগুলো কুঠুরি মাটি দিয়ে ভরাট করা। নিচ থেকে ধাপে ধাপে বিন্যস্ত কুঠুরিগুলো একটি চমৎকার স্থাপনার কাঠামো নির্দেশ করে। এটি হলো স্থাপনাটির মঞ্চ অংশ। উপরের মূল নির্মাণামলের অংশটি এমনভাবে ধ্বংস হয়েছে যে সেটির পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়নি। 

প্রথম নির্মাণামলের চূড়ার উপরের পুরনো অংশটির উপর পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বিভাবি বিন্যস্ত একটি সারিতে পরপর তিনটি চৌকা কোঠা নির্মিত হয়েছিল। উভয় কোঠায় কেবল পশ্চিম দিকে একটি করে দরজা ছিল, অর্থাৎ স্থাপনাটি পশ্চিমমুখী ছিল। সেটির সামনের অংশে একটি মন্ডপ ও পেছনে একটি গর্ভগৃহ বা মূর্তিকোঠা ছিল। দ্বিতীয় পুনর্নিমাণকালে দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়ে মেঝের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। মেঝের মাঝখানে ৮.১৩ বর্গমিটার আয়তনের চৌবাচ্চার মত অংশ পাওয়া গিয়েছে। 

যেটুকু স্থাপনা উন্মুক্ত করে গবেষণা করা গিয়েছে, সে থেকে ধারণা করা হয় যে, সম্ভবত গুপ্ত যুগের শেষ পর্যায়ে খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে ক্রুশাকারে ভিত্তির উপর ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া ভরাট কক্ষগুলির শীর্ষে একটি বৌদ্ধস্তুপ নির্মিত হয়েছিল। পালযুগের কোন এক সময় স্তুপটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে একাদশ – দ্বাদশ শতাব্দীতে স্তুপটির উপরে একটি শিবমন্দির স্থাপিত হয়। 

মন্দিরের ভগ্নাবশেষ খনন করে একটি নরকঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। ভেতরে পাওয়া গিয়েছে ১২ ফুট ৮ ইঞ্চি বা ৩.৮৬ মিটার পরিধির কক্ষ, যার মাঝখানে একটি ১ ফুট ৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ১ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থ বিশিষ্ট প্রস্তরখন্ড পাওয়া গেছে। মাঝখানে একটি বড় গর্ত এবং চারপাশে ১২ টি গর্ত পাওয়া গিয়েছে। মাঝখানের গর্তটিতে আবিস্কৃত হয়েছে ৬.৪৫ বর্গ সে.মি. আকারের একটি স্বর্ণপাত্র, যাতে উপবিষ্ট নন্দীর প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ রয়েছে। পুণ্ড্র মাহাত্ম্যে ভৃগু কর্তৃক পৌণ্ড্রনগরের নৈঋত কোণে কোটিলিঙ্গ নামে একটি শৈব পীঠস্থান স্থাপনের কথা জানা যায়। হারিয়ে যাওয়া সেই কোটিলিঙ্গ পীঠের অবস্থান ও গোকুল মেধের অবস্থান মিলে যায়। এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া গেলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হবে। এটি বলা যেতেই পারে যে, অশোক স্তুপের উপরে শিব মন্দিরটি পাল আমলের অবসানে নির্মিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে সেন আমলে পুণ্ড্রে বৌদ্ধদের হটিয়ে হিন্দুধর্ম প্রবল হয়ে ওঠে এবং এখানের শেষরাজা পরশুরাম হিন্দু ছিলেন। কোটিলিঙ্গ ছাড়াও আরো অনেকগুলো শক্তিপীঠের অবস্থান এখনো সনাক্ত করা সম্ভব, যেগুলো সবসময় অবহেলিত। 

গোকুল মেধ এর প্রকোষ্ঠাকৃতির নির্মাণশৈলীকে ড: নাজিমুদ্দিন আহমদ উত্তর প্রদেশের বেরেলি জেলায় অবস্থিত অহিচ্ছত্রের প্রাচীন স্থাপনার সাথে তুলনা করেছেন। 

বুদ্ধের পদার্পনের গৌরবময় ইতিহাসের কথা বুকের কোথাও লুকিয়ে রেখেছে গোকুল মেধ। নিরঞ্জনা নদীর তীরে কৃশদেহী ধ্যানমগ্ন বুদ্ধকে পায়সান্ন নিবেদন করেছিলেন সুজাতা। সে ঘটনাটি চিত্রিত হয়ে রয়েছে গল্পের আকারে, চিত্রকর্মের মধ্যে, কিছু প্রাচীন স্থাপনার দেয়ালে পোড়ামাটির ফলকের মাধ্যমে। সুমাগধা বুদ্ধকে কি নিবেদন করেছিলেন জানা যায় না। আজকে যেখানে গোকুল মেধ পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত, ঠিক সেখানেই বহু শতাব্দী আগের একটি দিনে প্রথম সূর্যালোকের সাথে সাথে উদ্ভাসিত হয়েছিল তথাগতের মহিমাময় রূপ, সম্মুখে অঞ্জলিবদ্ধ সুমাগধা, বুদ্ধের ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা, চোখ অর্ধ উন্মীলিত। দূরে মাঠের ওপারে কুয়াশার পাতলা চাদর তখনো কাটে নি। ভোরের শীতল বাতাসের সাথে সুশীতল শান্তির বাণী ঘোষিত হয়েছিল বুদ্ধের সুমধুর কণ্ঠ থেকে। মধুক্ষরা বুদ্ধের বাণী, মধুক্ষরা পুণ্ড্র, আমার পুণ্ড্র।


তথ্য ঋণ:

১. মহাস্থান, মোঃ মোশারফ হোসেন ও মোঃ বাদরুল আলম 
২. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান
৩. পৌণ্ড্রবর্ধন ও করতোয়া, শ্রী হরগোপাল দাসকুণ্ডু
৪. অবদানকল্পলতা, সুমাগধাবদান
৫. উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, কমল চৌধুরী সম্পাদিত

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)