ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (২৮ তম পর্ব)

|| পুণ্ড্রের রত্নভাণ্ডার: প্রাচীন মুদ্রা || 

১৮৬৪ সাল। মহাস্থানগড় থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বামনপাড়া গ্রামের নিকটস্থ সুউচ্চ একটি প্রাচীন ঢিবিতে এক কৃষক মাটি খুঁড়তে গেলে বেরিয়ে এল বারো প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট একটি সুপ্রাচীন স্থাপনা। পাওয়া গেল ইতিহাসের নানা অমূল্য সম্পদ। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা। ইতিহাসবিদ হেনরি বেভারিজ এর থেকে দুটি স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহ করে এশিয়াটিক সোসাইটিতে প্রেরণ করেন, যার একটি গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের এবং অপরটি কুমারগুপ্তের। খুব সম্ভবত বাকী মুদ্রাগুলোও গুপ্ত আমলের, যেগুলোর কোন হদিস পরবর্তীতে পাওয়া যায় নি। কুমারগুপ্তের মুদ্রাটির একপাশে "শ্রীমহেন্দ্রসিংহ পরাক্রম" এবং অপর পাশে "কুমারগুপ্ত" লেখা উৎকীর্ণ ছিল।


১৮৭২ সালে মহাস্থানগড়ে আরেকজন কৃষক ধানক্ষেত চাষ করতে গিয়ে উঠে আসে সুলতানী আমলের অনেকগুলো রৌপ্য মুদ্রা। এর কয়েক বছর পর আরেকজন কৃষক জমি চাষ করতে গিয়ে একটি ধাতব পাত্র ও একটি স্বর্ণমুদ্রা পান। এ মুদ্রাটিতে কোন লেখা উৎকীর্ণ করা ছিল না, বরং এক পাশে পদ্মাসনা নারী মূর্তি এবং অপর পাশে দণ্ডায়মান পুরুষ মূর্তি খোদিত ছিল। ঠিক এমনি ভাবে জমি চাষের সময় আরেক কৃষক কতগুলি রৌপ্য মুদ্রা পান, যেগুলিতে কেবলমাত্র ত্রিশুল হাতে নন্দীসহ শিবের মূর্তি খোদিত ছিল। 


এ সমস্ত মুদ্রার বিষয়ে খোঁজ দিয়েছেন শ্রীহরগোপাল দাসকুণ্ডু মহাশয় তাঁর বিভিন্ন লেখার মধ্য দিয়ে। দুঃখজনকভাবে বর্তমানে এ মুদ্রাগুলোর হদিস আমার জানা নেই, মহাস্থান বিষয়ক হাল আমলের নথিপত্রেও কোন তথ্য পাইনি।


পরবর্তীকালে পরিকল্পিতভাবে মহাস্থানগড়ে উৎখননের ফলে আরো প্রচুর মৌর্য, শুঙ্গ, গুপ্ত, পালযুগ, এমনকি সুলতানী আমলের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব মুদ্রার পাঠোদ্ধার মহাস্থানগড় তথা পুণ্ড্রের ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ করেছে।


পুণ্ড্রের পূর্বদিকের সুরক্ষা প্রাচীর ঘেঁষে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত উৎখননের সময় ৩১ টি ছাপাঙ্কিত মুদ্রা (Punch marked) পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে মোট ১৫ টির পাঠোদ্ধার করা গিয়েছে। মুদ্রাগুলো খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় থেকে ২য় শতকের সময়কালের, অর্থাৎ মৌর্যযুগের শেষ দিক থেকে শুঙ্গযুগের। সবগুলো মুদ্রাতে কোন লেখা উৎকীর্ণ করা নেই; কেবলমাত্র কিছু চিহ্ন খোদিত রয়েছে। 


কোন স্থানের ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে মুদ্রার ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুদ্রার মাধ্যমে সে স্থানের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা করা যায়। ছাপাঙ্কিত মুদ্রার পাঠোদ্ধার একটি দুরূহ কাজ। কেননা, এসব মুদ্রায় খোদিত চিহ্নাবলীর বহুমাত্রিক অর্থ আরোপ করা যেতে পারে। এর ফলে সুনিশ্চিত অর্থ উদঘাটন করা সুকঠিন। আর তাই ছাপাঙ্কিত মুদ্রার অর্থ উদঘাটন নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। 



ছবির মুদ্রাটি মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত শুঙ্গ আমলের একটি ছাপাঙ্কিত মুদ্রা। মুদ্রাটির সাইজ ১.৯৪ × ১.৮৩ × ০.০৮ সেন্টমিটার। মুদ্রাটির এক পিঠে (Obverse) রয়েছে চারটি চিহ্ন এবং অপর পিঠে (Reverse) রয়েছে আরো চারটি চিহ্ন। প্রত্যেকটি চিহ্ন বিশেষ অর্থবহ সেটি বলা বাহুল্য। 


মুদ্রাটির উপরের পিঠে (Obverse) যে চিহ্নগুলো রয়েছে:

১. উপরের বামে নন্দীপদ বা বৃষ ক্ষুর (Taurine)
২. নীচের বামে স্বস্তিকা চিহ্ন (Swastika)
৩. উপরের ডানে হাতি (Elephant)
৪. নীচের ডানে, মানে হাতির নীচে জয়ধ্বজ (Jayadhwaja)


মুদ্রাটির অপর পিঠে (Reverse) যে চারটি চিহ্ন রয়েছে:

১. উপরের বামে তিনটি পাহাড়ের চূড়া ও চাঁদ (Three arched hills with crescent)
২. নীচের বামে ফাঁপা ক্রস (Hollow cross)
৩. মাঝে রয়েছে নন্দীপদ বা বৃষ ক্ষুর (Taurine)
৪. বেদীযুক্ত গাছ বা চৈত্য বৃক্ষ (Tree in railing)


প্রত্যেকটি চিহ্ন পুণ্ড্রের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়বহ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। 
এবার প্রতিটি চিহ্নের বিষয়ে আলাদাভাবে আলোকপাত করা যাক।


উপরের পিঠ (Obverse):

১. নন্দীপদ বা বৃষ ক্ষুর (Taurine): প্রাচীন মুদ্রায় এ চিহ্নটির উপস্থিতি ব্যাপকভাবে চোখে পড়ে, বিশেষত মৌর্য ও পরবর্তী কালে। এ চিহ্নটি শিবের উপস্থিতি জ্ঞাপক। বলা হয়ে থাকে, যেখানে শিব সেখানেই নন্দীর অবস্থান। প্রাচীন ভারতে শিবের প্রভাব যে কতটা গভীর, মুদ্রায় এ চিহ্নের অহরহ ব্যবহার সেটির ইঙ্গিত দেয়। আমরা করতোয়া মাহাত্ম্য থেকে জানতে পারি, বৌদ্ধপ্রধান পুণ্ড্রে শিব উপাসনার প্রভাব একসময় বুদ্ধের প্রভাবকে ছাড়িয়ে যায়। ফলে বিপুল সংখ্যক শিবমন্দির নির্মাণের কথা জানা যায়। এমনকি প্রায় সবগুলো বৌদ্ধ মন্দিরের উপর শিবমন্দিরের অস্তিত্ব বিরাজমান। তদুপরি পুণ্ড্রে হিন্দুদেবী মনসা ও বৌদ্ধদেবী জাঙ্গুলীর উপাসনা (নাগপূজা) ইতিহাসখ্যাত। সংযোগটা এখানেও শিবের সাথে। পুণ্ড্রের শেষ রাজা পরশুরাম শৈব এবং তাঁর কন্যা (মতান্তরে ভগ্নি) প্রখ্যাত সিদ্ধা। ডাকিনীর ধাপ নামে ঢিবির অবস্থান এখনো রয়েছে পুণ্ড্রে। সবমিলিয়ে পুণ্ড্রে শৈব প্রভাবের দ্যোতক এই বৃষ ক্ষুর চিহ্ন।

২. স্বস্তিকা চিহ্ন (Swastika): এ চিহ্নটি সুপ্রাচীন কাল থেকে মাতৃকা উপাসনায় ব্যবহৃত হয়। আজো হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মাঙ্গলিক কাজে এ চিহ্ন ব্যবহার করে। পুণ্ড্রে তন্ত্রচর্চার ব্যাপ্তির দ্যোতক হিসেবেই মুদ্রায় স্বস্তিকা চিহ্ন স্থান পেয়েছে। পুণ্ড্রে তন্ত্রের প্রভাব এতটাই বেশি ছিল যে, পৌণ্ড্রবর্ধন চক্র নামে আলাদা সাধনপদ্ধতির প্রচলন ছিল।

৩. হাতি (Elephant): হাতি মূলত শক্তিমত্তা ও কর্মকুশলতার প্রতীক। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মে হাতির উপস্থিতি মঙ্গলময় বিবেচনা করা হয়। অশোক স্তম্ভে হাতির উপস্থিতি, শিব দ্বারা গণেশের মস্তক প্রতিস্থাপন, কর্মকুশলী বিশ্বকর্মার বাহন হিসেবে হাতি, বুদ্ধের জন্মের আগে মায়াদেবীর স্বপ্নে শ্বেত হস্তী দর্শন এবং  মহাভারত ও অন্যান্য গ্রন্থে পুণ্ড্রের হস্তীবাহিনীর বিশালতা ও যুদ্ধনৈপুণ্যের বর্ণনা – এ সব কিছুই মুদ্রায় হাতির উপস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট। 

৪. জয়ধ্বজ (Jayadhwaja): মৌর্য ও শুঙ্গ মুদ্রায় এ চিহ্নটি করদ রাজ্যের নির্দেশবহ বলে মনে হয়। 
উপরে বর্ণিত মুদ্রার উপরের পিঠের (Obverse) চিহ্নগুলো থেকে পুণ্ড্রের অতীত গৌরবের হস্তীবাহিনী,  মৌর্য ও শুঙ্গদের জয়ধ্বজ, শৈব ও বৌদ্ধধর্মের সমপ্রভাবের বার্তা দেয়।


অপর পিঠ (Reverse):

১. তিনটি পাহাড়ের চূড়া ও চাঁদ (Three arched hills with crescent): অধিকাংশ গবেষকগণ এ চিহ্নটি বৌদ্ধ স্তুপের প্রতীকী বলে মত দিয়েছেন। পুণ্ড্রে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবের কথা বলাই বাহুল্য। তদুপরি মৌর্য আমলে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিশ্বজনীন। সুতরাং মুদ্রায় স্তুপের উপস্থিতি অতীব যুক্তিযুক্ত।

২. ফাঁপা ক্রস (Hollow cross): এ চিহ্নটির বিষয়ে কয়েকটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। প্রথমত, বৌদ্ধধর্মে অষ্টকোণাকৃতির স্থাপত্য মঙ্গলের প্রতীক। সোমপুর মহাবিহার এবং অন্যান্য বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরের স্থাপত্য এ স্থাপত্যরীতি মেনে করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তন্ত্রে এ চিহ্নটির মতো যন্ত্র ব্যবহৃত হশ। সে হিসেবে মাতৃকা উপাসনার প্রতিনিধিত্ব করছে এ চিহ্নটি। তৃতীয়ত, তক্ষশিলার বিশেষ চিহ্ন এটি। এখানে পাপ্ত মুদ্রায় এ চিহ্ন সহজেই পাওয়া যায়। অনেকে জলের চৌবাচ্চা বা কূপের সাথে, আবার যজ্ঞের অগ্নিকুণ্ডের সাথে এর সাদৃশ্য পান। তবে আমার কাছে এটি বৌদ্ধদের অষ্টকোণাকৃতি অথবা তন্ত্রের যন্ত্র বলেই মনে হয়েছে। আমরা আগেও পুণ্ড্রে বৌদ্ধ ও তন্ত্র প্রভাবের কথা বলেছি। 

৩. নন্দীপদ বা বৃষ ক্ষুর (Taurine): আগেই আলোচনা হয়েছে। 

৪. বেদীযুক্ত গাছ বা চৈত্য বৃক্ষ (Tree in railing): চৈত্য বৃক্ষ বৌদ্ধদের কাছে পবিত্র চিহ্ন, বিশেষত বোধিবৃক্ষ। ত্রিশুলের মতো দেখতে হলেও এটি বৃক্ষ সে বিষয়ে খুব একটা বিতর্ক নেই। মৌর্য ও শুঙ্গ মুদ্রায় ইটের বেদীতে বৃক্ষের পাশাপাশি গমের শীষ, ধানের শীষ এসবও পাওয়া যায়। অনেক মুদ্রায় কেবল বেদীও দেখা যায়, অনেকটা মইয়ের মতো দেখায় সে ক্ষেত্রে। আমার কাছে এ ইটের বেদীটি নগরায়নের প্রতীকী মনে হয়েছে। যে সমস্ত প্রত্নস্থলে এমন মুদ্রা পাওয়া গেছে, সবগুলোই প্রাচীন নগর। তাই নগরায়নের প্রতীক হলো এ ইটের প্রাচীরের অংশ বা বেদীটি। বর্তমানে টাকা ও মুদ্রায় বিশেষ স্থাপনাকে ছাপাতে দেখা যায় জাতীয় গৌরব হিসেবে। এ যেত তারই সুপ্ত বহমান ধারা। 


সবমিলিয়ে মুদ্রার এই পিঠটি যেন বৌদ্ধ প্রভাবের বার্তাবহ। Obverse দিকটির চিহ্নগুলোকে যদি শৈব মতের আলোকে দেখা হয় এবং Reverse দিকের চিহ্নগুলো বৌদ্ধ মতের আলোকে দেখা হয়, তাহলে দুয়ে দুয়ে চার হয়। মানে পুণ্ড্রের দুই শক্তিশালী মত - শৈব ও বৌদ্ধ মতের প্রতিনিধিত্ব করছে মুদ্রার দুই পিঠ। অবশ্য মুদ্রার অর্থ উদঘাটন একটা বিতর্কের বিষয় সেটি গবেষকগণ বলে থাকেন।


ভবিষ্যতে আমরা পুণ্ড্রের বাকী মুদ্রা নিয়ে আলোচনা করবো বলে প্রত্যাশা রাখছি। 


তথ্যসূত্র:

১. Catalogue of the Indian Coins in the Indian Museum Calcutta, Vol I, Vincent A. Smith
২. Second Interim Report (1993 - 99), France - Bangladesh Joint Venture Excavations at Mahasthangarh 
৩. পৌণ্ড্রবর্ধন ও করতোয়া, শ্রী হরগোপাল দাসকুণ্ডু 

ছবিঋণ: 

ছবিটি শিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়েছি: Second Interim Report (1993 - 99), France - Bangladesh Joint Venture Excavations at Mahasthangarh থেকে। যেকোন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা নিষেধ।

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)