ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (২৯ তম পর্ব)

|| বৈগ্রাম তাম্রশাসন ও কিছু তথ্য ||



(Baigram Copper Inscription)




যেখানেই ইতিহাসের গন্ধ পাই, সেখানে ছুটে চলে যাই। পুরনো নথিপত্র পড়তে গিয়ে এবারে খেয়াল করলাম, বৈগ্রাম জায়গাটি বাড়ি থেকে মাত্র ২৪/২৫ কিলোমিটার দূরে। অমনি বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য গুপ্ত যুগের পুরাকীর্তি দেখবো।


বাংলায় গুপ্তযুগের তাম্রশাসন যেসকল স্থানে পাওয়া গিয়েছিল, দিনাজপুর জেলার দামোদরপুর ও বৈগ্রাম তাদের মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৫ সালে দামোদরপুরে দুটি পুরনো পুকুরের মাঝখান দিয়ে রাস্তা মেরামত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে পাঁচ-পাঁচটা তাম্রশাসন, তা-ও আবার গুপ্তযুগের, প্রথম কুমারগুপ্তের শাসনামলের, সাল ১২৪ গুপ্তাব্দ (৪৪৩/৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)। এর পনের বছর পরে ১৯৩০ সালে দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার বৈগ্রামে পুরনো পুকুর খনন করতে গিয়ে পাওয়া গেল প্রথম কুমারগুপ্তের আরো একটি তাম্রশাসন। বাংলায় গুপ্ত শাসনের অনবদ্য দলিল এ তাম্রশাসনগুলো।


বৈগ্রাম তাম্রশাসন নিয়ে কয়েকটি তথ্য দিবো এখানে। ১২৮ গুপ্তাব্দ, মানে ৪৪৭/৪৮ খ্রিষ্টাব্দে এ তাম্রশাসনটি জারীকৃত। কোন ভূমিদান বিষয়ক নয়, বরং জমি ক্রয়ের দলিল এটি। পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির পঞ্চনগরী বিষয়ের বৈগ্রাম নিবাসী ভোয়িল ও ভাস্কর নামের দুইজন ব্যক্তি ত্রিবৃতা ও শ্রীগোহাইল গ্রামে দুই কুলব্যাপ খিলভূমি (করমুক্ত রাষ্ট্রীয় জমি, খাস জমি) এবং দুই দ্রোণ পরিমিত স্থলবাস্তু (বসতজমি) ক্রয়ের জন্য পঞ্চনগরীর বিষয়াধিকরণ কুমারামাত্য কুলবৃদ্ধির নিকট আবেদন করেছেন। বিষয়াধিকরণ সমস্ত জমির বিষয়ে সরেজমিনে খোঁজ করে এবং গ্রামমণ্ডলী ও অন্যান্য রাজকর্মচারীদের সাথে কথা বলে প্রতি কুলব্যাপ জমি দুই দিনার হিসেবে মূল্য গ্রহনপূর্বক জমি ক্রয়ের আবেদন অনুমোদন করেছেন। ক্রেতাগণ জমি ক্রয়ের উদ্দেশ্যও দলিলবদ্ধ করেছেন: তাঁদের পিতা শিবনন্দী কর্তৃক স্থাপিত বৈগ্রামের গোবিন্দস্বামী মন্দিরের খরচ বহনের জন্য জমিগুলো দান করেছেন। এ সমস্ত বিষয়ের বিশদে উল্লেখ করে সম্রাট প্রথম কুমারগুপ্তের পক্ষ থেকে এ দলিলটি জারি করা হয়। ৯ x ৫ ইঞ্চি আকারের তাম্রশাসনের এক পিঠে ১৫ টি ও অপর পিঠে ১০ টি লাইনে সংস্কৃত ভাষায় লিপিটি উৎকীর্ণ। তাম্রশাসনে সীলমোহর ব্যবহার হয়েছিল বোঝা গেলেও সেটির প্রকৃতি ও লেখা কালক্রমে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। তাম্রশাসন বাংলায় গুপ্ত শাসনের নানা দিক নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। আমরা এ নিয়ে এবং অপর তাম্রশাসনগুলো নিয়ে বিশদে আলোচনা করবো পরবর্তীতে। 








আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার উদ্দেশ্য বৈগ্রামের কোথায় এ তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছিল এবং কোন মন্দিরটির জন্য এটি জারি হয়েছিল সেসব দেখার। বৈগ্রাম জায়গাটি দিনাজপুর জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম, তারকাঁটার ওপারে পশ্চিম বাংলা। বৈগ্রামে পৌঁছে খোঁজ করে জানলাম, একটি অতি প্রাচীন মন্দির আছে, যেটি শিববাড়ী নামে পরিচিত। মন্দিরটির ঐতিহাসিক নাম গোবিন্দস্বামী, কিন্তু এখন শুনলাম শিব মন্দির। বিষয়টি গোলমেলে ঠেকলো। 


যাইহোক, খুঁজতে খুঁজতে হাজির হলাম সেখানটায়। বেশ অনুচ্চ একটি ইটের ঢিবি রয়েছে এখানে। আকারে একসময় বেশ বড় ছিল সন্দেহ নেই, এখন ছোট হয়ে এসেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সতর্কীকরন সাইনবোর্ড লাগানে আছে দেখলাম। 


ঢিবির উপরে একটা জায়গা গোলাকার রয়ে গিয়েছে, যেখানটায় সম্ভবত গৌরীপট্ট স্থাপিত ছিল। ঢিবির পাশে প্রাচীন বটগাছ। অযত্ন অবহেলার একশেষ। প্রাচীন শিবলিঙ্গটি ১৯৯৬ সালের দিকে চুরি হয়ে গিয়েছে। তাই হাল আমলের ছোট শিবলিঙ্গ বানিয়ে পূজা করে হিন্দুরা। মন্দিরের ঢিবির উপর টিনের চালা দিয়ে একটা ঘরে কালী মন্দির করা হয়েছে। আর কোন বিশেষত্ব নেই। ঢিবি থেকে সামান্য দূরেই সেই প্রাচীন পুকুরটি, যেখানে তাম্রশাসনটি পাওয়া যায়। সম্ভবত পুকুরটিও একসময় এ মন্দিরের কাজে ব্যবহৃত হতো। অবশ্য বৈগ্রামে বর্তমানে মাত্র একটি হিন্দু পরিবার রয়েছে, পেশায় কর্মকার। এই পরিবারটি মন্দির ঢিবিটি আগলে রেখেছেন। অন্যদের পথ অনুসরণ করে তাঁরাও যেতে চান ওপার বাংলায়, যেখানে বাকী সব প্রতিবেশী আগেই চলে গিয়েছে। তাঁরা গেলে যেটুকু ঢিবি গুপ্ত আমলের ইতিহাস বুকে নিয়ে ধুঁকছে, সেটিও ছুটি পেয়ে যাবে। অনেক তো হলো, আর কতকাল রইবি? 


তথ্যসূত্র:

১. বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব), নীহাররঞ্জন রায়
২. Epigraphia Indica, Vol. XXL
৩. বাঙ্গালার ইতিহাস (১ম খণ্ড), রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়
৪. নিজস্ব ক্ষেত্রসমীক্ষা

|| প্রকাশিতব্য বইয়ে তাম্রশাসনটি নিয়ে অতি বিশদ আলোচনা করার আশা রয়েছে। || 

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৪র্থ পর্ব)