ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৫৯ তম পর্ব)

|| কাঁঠাল কথা ||

কাঁঠাল - ঢাউস একটি ফল, সারা গায়ে তার কাঁটা, তেমনি তার আঠা। বাঙালি বড়ই রসিক, কাঁঠালের আঠাকে তুলনা করেছে পীরিতির সাথে। পীরিতি কাঁঠালের আঠা... সেই কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। ছোটবেলায় মাথায় ঘুরতো একটি প্রশ্ন- জাতীয় ফল কাঁঠাল কেন? এর উত্তর পণ্ডিতমহল নিজের মতো করে বুঝিয়েছেন, সার্বজনীন উত্তর পাই নি। তবে নানা জনের মতামত শুনে যা উপলব্ধি করেছি তা হল, কাঁঠালের সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে ব্যাপ্তি, সহজলভ্যতা ফলটির সর্বব্যাপী ব্যবহার - মানে কাঁচাও খাওয়া যায়, পাকলে তো বটেই, এমনকি সবটুকু অংশই কাজে লাগে, কাঁঠালের বীজসমেত। এর পাশাপাশি দেশের বৃহৎ অংশ, যাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বেশি নয়, গ্রীষ্মকালে তাদের সারা দিনের খাদ্য চাহিদার অনেক অংশ কাঁঠাল খেয়ে পূরণ সম্ভব। কাঁঠালের মধুময় রস বাঙালিমাত্রই প্রিয়। এটাও ভুললে চলবে না, কাঁঠাল কিন্তু পৃথিবীর একক বৃহত্তম ফল! 



গ্রীষ্মের শুরুতেই এ বছর যে গরম পড়েছে, কাঁঠালের কথা মনে পড়ছে - এই তো বছরঘুরে আবারো এসে গেল কাঁঠালের মরসুম। আমার মতো আমপ্রেমী আমজনতার কাছে কাঁঠাল একটি গুরুপাক খাবার। এটা আমার কথা নয়, সেনরাজকবি উমাপতিধর স্বয়ং বলেছেন দেখুন:
পৃথুত্বাৎ সৌরভ্যান্ মধুরতরভাবাচ্চ পতিতৈঃ
ক্ষুধাতপ্তৈ কুক্ষিম্ভরিভিরিহ সেবা তব কৃতা।
তদাত্বব্যামুগ্ধৈরনুদিবসমস্বাস্থ্যজননী
ন দৃষ্টা তে হস্মাভিঃ পনস পরিণামে বিরসতা।

অর্থ: বড় আকার ব'লে সুগন্ধ ব'লে অত্যন্ত সুমিষ্ট ব'লে ক্ষুধাপীড়িত লোকেরা ছুটে এসে পেট ভরাবার জন্যে এ দেশে তোমার সেবা করেছিল। তারপর থেকে, হে কাঁঠাল, অত্যন্ত বোকা আমরা দিনের পর দিনেও তোমার অস্বাস্থ্যকর পরিপাক-দুঃখ লক্ষ্য করি নি।

আরো কয়েকশ বছর পিছিয়ে গেলে দেখবেন, সেখানেও কাঁঠালের উৎপাত। হিউয়েন সাং পুণ্ড্রে পনস্ [কাঁঠাল] ফলের প্রাচুর্যের কথা বলেছেন। এ ফলটি নাকি গাছের গোড়া থেকে আগা অবধি ফলে এবং প্রচুর পরিমাণে ফলতে দেখেছেন হিউয়েন সাং। এখনো পুণ্ড্রের সবখানে কাঁঠাল গাছ চোখে পড়ে, ফলও ধরে তাজ্জব রকমের বেশি। 

পাল আমলেও কাঁঠাল তার আঠা লাগিয়ে বাঙালির সাথে এঁটে লেগেছিল। সোমপুর মহাবিহারের অজস্র টেরাকোটার মধ্যে দুটি টেরাকোটায় রয়েছে কাঁঠালের উপস্থিতি। একটি টেরাকোটায় একটি বানর বা হনুমান কাঁঠাল ভেঙে খাচ্ছে। আরেকটিতে একটি বানর বা হনুমান কাঁঠাল কাঁধে পলায়নরত। 


মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যেও কাঁঠাল উপস্থিত; বিশেষত বাঙালির রসনা বিলাসে সুমিষ্ট পাকা কাঁঠাল, কাঁচা কাঁঠাল ও এর বীজের সরব উপস্থিতি বিদ্যমান। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে আমরা দেখতে পাই, সওদাগর ধনপতি সিংহলরাজের জন্য ভেট নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর উপহারসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে পনস্ বা কাঁঠাল।
আনন্দিত সদাগর                      ভেটিব সিংহলেশ্বর।
                       ভেটঘাট করিল জোজনা।
কলা নিল মর্তমান                      মজা গুয়া পাকা পান।
                       আম্র পনস নারিকেল।

খুল্লনার ভোজ আয়োজনেও রয়েছে কাঁঠাল, তা-ও আবার যাকে বলে ডেজার্ট হিসেবে, মানে ভোজনের শেষভাগে মিষ্টিমুখ করার জন্য। 
দধি পিঠা খাইল সবে মধুর পায়স
রসাল পনস-কোষ রসালের রস।

বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসামঙ্গলে নৈবেদ্যের বর্ণনায় পাই:
নানা দিব্য রচনা নৈবিদ্য আদি যত।
অতিরম্য দশ ফল করিল মজুত।
কদলী কর্কট ফুটী নারিকেল জাম।
খাজুর পনস তাল পূগ পূর্ণ আম। 

আবার চাঁদ সদাগরের নাখরা বনে যে সকল গাছের উল্লেখ রয়েছে, সরস কাঁঠালগাছ তার মধ্যে অন্যতম। 

চৈতন্য চরিতামৃতে খাবারের বহরে কাঁঠালের দেখা পাই:

ছেনা পানা পৈড় আম্র নারিকেল কাঁঠাল।
নানাবিধ কদলক আর বীজতাল। 

উনিশ শতকের শেষের দিকে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় প্রণীত রান্না বিষয়ক বই "পাক প্রণালী"তে পাকা কাঁঠালের মিষ্ট বড়া রান্নার কথা পাওয়া যায়। পাকা কাঁঠালের রসের সাথে চালের গুঁড়া ও চিনি মিশিয়ে ঘন মণ্ড তৈরী করতে হবে। সেই মণ্ড গরম ঘিয়ে ভেজে চিনির রসে ডোবালেই তৈরী হবে কাঁঠালের বড়া। এই বড়া নাকি ক্ষীরসহযোগে খেতে অসাধারণ লাগে। এছাড়া এঁচোড় (কাঁচা কাঁঠাল) রান্নার কথাও রয়েছে এ বইতে। 

কাঁচা কাঁঠাল বা এঁচোড় তো বাঙালির কাছে "গাছপাঁঠা", ভালো করে কষিয়ে রাঁধলে অমৃততুল্য। 

চরক সংহিতায় যে ছাব্বিশটি ফল থেকে ফলাসব তৈরী করা যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কাঁঠাল তার মধ্যে অন্যতম। আবার টক ফলের পাশাপাশি কাঁঠাল সহযোগে দুধ খেতে নিষেধ করা হয়েছে। 

রসনা বিলাসের পাশাপাশি বাঙালির সমুদ্রযাত্রায় ছিল কাঁঠালগাছের ব্যবহার। নৌকার কেরয়াল দণ্ড বা দাঁড় নির্মাণে ব্যবহৃত হতো কাঁঠাল গাছের কাঠ। আজো কাঁঠাল কাঠের আসবাবপত্রের সুখ্যাতি রয়েছে, যদিও কালপরিক্রমায় নানা ধরণের কাঠ ও পার্টিকেল বোর্ড কাঁঠাল কাঠের পরিবর্তে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

একটি মজার বিষয় হলো, কৃত্তিবাসী রামায়ণে রামচন্দ্রের পনস নামের একজন সেনাপতির নাম পাওয়া যায়। লঙ্কাকাণ্ডে রামচন্দ্রের অভিষেক অনুষ্ঠানে আমরা পাই:

ঋষভ কুমুদ দেখ পনস সম্পাতি।
নল নীল দেখ এই মুখ্য সেনাপতি।। 

এখানে পনস নামটি কোন অর্থবাচক তা জানি না; তবে পনস সমৃদ্ধ দেশ [পুণ্ড্র] হতে আগত কোন সেনাপতিকে বুঝানো হয়েছে কি? কেকয় দেশ থেকে আগত রাণীর নাম যদি কৈকেয়ী হতে পারে, পনসের দেশ থেকে আগত কারুর নাম পনস হতে পারে কি? আমার জিজ্ঞাসু মনের প্রশ্ন এটি। 

কাঁঠালের পাতার সাথে বরেন্দ্রীর একটি ধর্মাচরণের খুব গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে, বিশেষত কৈবর্ত, নরসুন্দর, সাহা জাতিদের মধ্যে একটি বিশেষ ব্রত প্রচলিত রয়েছে, যেটি বাংলার অন্য অঞ্চলে দেখা যায় না। "গোপালের ব্রত" নামে এই ব্রতটি সারা অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে পালিত হয়। এ ব্রতপালনে কাঁঠাল পাতা অপরিহার্য। অগ্রহায়ণের প্রতি রবিবারে সূর্যোদয়ের সময় গোপালের উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য দেওয়া হয় তুলসীতলায় সাতটি কাঁঠাল পাতায় করে। আতপ চাল, কলার টুকরো ও বাতাসা বা চিনি এ নৈবেদ্যের প্রধান উপচার। ধূপদীপ সহযোগে শঙ্খধ্বনি করে এ নৈবেদ্য নিবেদন করে পরিবারের নারী সদস্যরা। সারা মাস ব্রত পালন করে অগ্রহায়নের শেষদিন ব্রাহ্মণ এনে গোপাল পূজা করা হয়। এ সময় বরেন্দ্রজুড়ে হাটে-বাজারে গোপালমূর্তি বিক্রয় করে কুমোররা। ব্রতটিতে কোন ব্রতকথা শোনা হয় কিনা জানা নেই। উল্লেখ্য যে, এ অঞ্চলে প্রচলিত ইতুপূজা ব্রতটির বিকল্প হিসেবে এই ব্রতটি পালিত হয়। এখানে তথ্যটুকু দিলাম কাঁঠালের সাথে বাঙালির ধর্মাচরণের গভীর সম্পর্কটা বুঝাতে। 

বৈষ্ণবাচার পদ্ধতি ও শ্রীহরিভক্তি বিলাস গ্রন্থদুটিতে যে সমস্ত খাদ্যদ্রব্য হবিষ্যদ্রব্য হিসেবে ব্যবহারযোগ্য বলা হয়েছে, পনস বা কাঁঠাল তার মধ্যে অন্যতম। কালিকাপুরাণে নৈবেদ্যের তালিকায় পনসে্র নাম রয়েছে, "কুষ্মাণ্ডৈর্ন্নারিকেলৈশ্চ খর্জ্জুরৈঃ পনসৈস্তথা"।

পিতৃপক্ষে দীপদানে কাঁঠাল বীজের তেল ব্যবহারের প্রথাও রয়েছে কোথাও কোথাও। 

বাংলায় প্রচলিত অনেক বাগধারা ও প্রবাদে কাঁঠালের উজ্জ্বল উপস্থিতি। 'গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল', 'পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া', 'কাঁঠালের আমসত্ত্ব'', 'কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো' এ সবই আমাদের নিত্যদিনের কথায় মিশে থাকে। "সকল গাছ কাটিকুটি, কাঁঠাল গাছে দেই মাটি" – এটি খনার বচন। 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় কাঁঠাল খাইয়ে পাকসেনাদের জব্দ করার হাসির গল্পও বাংলায় ছড়িয়ে আছে। পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের হাসির গল্পে এক কাবুলিওয়ালার কাঁঠাল খেতে গিয়ে নাকাল হয়ে যাওয়া এবং তার দাড়ি হারানোর গল্প এখনো আমাদের হাসির খোরাক জোগায়। 
কোন অজানিত সময়ে বাঙালির পূর্বজদের সাথে কাঁঠালের পরিচয় হয়েছিল, তারপর কতশত শতাব্দী কেটে গিয়েছে। ইতিহাসের কোন এক অলিখিত ক্ষণে কাঁঠালের সাথে বাঙালির সখ্যতা হয়ে গিয়েছে। কাঁঠালের আঠার মতোই সেই সখ্যতা। সে কারণে খাবার থেকে শুরু করে মুখের বুলিতে কাঁঠালের উপস্থিতি আজো বহমান। 

শেষটা করছি বিদ্রোহী কবির একটি মজার ছড়ার চারটি লাইন উদ্ধৃত করে:

ওরে হুলোরে তুই রাতবিরেতে ঢুকিসনে হেঁশেল।  
কবে বেঘোরে প্রাণ হারাবি বুঝিসনে রাসকেল॥  
স্বীকার করি শিকারি তুই গোঁফ দেখেই চিনি,  
গাছে কাঁঠাল ঝুলতে দেখে দিস গোঁফে তুই তেল॥ 


তথ্যসূত্র:

১. বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব), নীহাররঞ্জন রায়
২. বৌদ্ধযুগের ভারত - হিউয়েন সাং, বারিদবরণ ঘোষ সম্পাদিত 
৩. কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম রচিত চণ্ডীমঙ্গল, সুকুমার সেন সম্পাদিত
৪. মনসামঙ্গল, বিপ্রদাস পিপিলাই
৫. চরক সংহিতা, শ্রীসতীশচন্দ্র শর্ম্মা সম্পাদিত 
৪. নিজস্ব ক্ষেত্রসমীক্ষা

ছবিঋণ:

পোস্টে ব্যবহৃত টেরাকোটার ছবিটি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সোহরাব উদ্দিনের সোমপুর মহাবিহারের টেরাকোটা নিয়ে একটি গবেষণাপত্র থেকে নেয়া হয়েছে। সেজন্য কৃতজ্ঞতাভরে তাঁর ঋণ স্বীকার করছি। 

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)