রামচরিত ও সন্ধ্যাকর নন্দী

রামচরিত। দ্বাদশ শতকে সন্ধ্যাকর নন্দী রচনা করেন রামচরিত। তখন পালযুগের অন্তিম পর্যায় ক্রমশ এগিয়ে আসছে, রামপালের পুত্র মদনপালদেব তখন সিংহাসনে। এমন ক্রান্তিকালে সন্ধ্যাকর নন্দী রচনা করেন গ্রন্থটি। বাংলার ইতিহাসের এটি একটি আকর গ্রন্থ। এই রত্নখানি আবিষ্কৃত না হলে বাংলার ইতিহাসের একটি বিশাল অধ্যায় অনাবিষ্কৃত থেকে যেত। বিশেষ করে কৈবর্ত বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যেত না। গ্রন্থটি আরো একটি কারণে অনন্য। সংস্কৃত সাহিত্যে খুব অল্পসংখ্যক কবি 'শ্লেষ' নামক অলঙ্কারে কাব্য লিখেছেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর মতে, কবি সুবন্ধু, বাণভট্ট, কবিরাজ ও স্বয়ং সন্ধ্যাকর এই চারজন কবি শ্লেষ অলঙ্কারে সংস্কৃত কাব্য রচনার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। এই অলঙ্কার প্রয়োগে কাব্য রচনা করলে একই শ্লোক বা চরণের দু'রকম অর্থ করা যায়। রামচরিত কাব্যে প্রতিটি শ্লোক দিয়ে একদিকে রামায়ণের রাম আর আরেকদিকে পালরাজ রামপাল-কে বোঝানো হয়েছে। নিচের শ্লোকটি দেখা যাক:

তৎকুলদীপো নৃপতিরভূদ্ ধর্ম্মো ধামবানিবেক্ষ্বাকুঃ।
যস্যাদ্ধিং তীর্ণাগ্রাবনৌ ররাজাপি কীর্ত্তিরবদাতা।।

এই শ্লোকে একদিকে রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ স্বয়ং ধর্মের প্রতিভূ সূর্যবংশীয় রাজা ইক্ষাকুর কথা বলা হয়েছে; আরেকদিকে রামপালের পূর্বপুরুষ পালবংশের গৌরব ধর্মপালদেবের কথা বলা হয়েছে। সমগ্র কাব্যজুড়ে এমন অসাধারণ সুখপাঠ্য শ্লোক রয়েছে। মূল গ্রন্থে ২২০ টি শ্লোক ছিল বলে জানা যায়। তবে আবিষ্কারের সময় ২১৫ টি শ্লোক পাওয়া গিয়েছে এবং বাকী ৫ টি শ্লোক চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে।


১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে এ গ্রন্থটি আবিষ্কার করেন। ১৯১০ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে গ্রন্থটির পাঠোদ্ধার টীকাসহ প্রকাশিত হয়। এরপর গবেষক অযোধ্যানাথ বিদ্যাবিনোদ সম্ভবত ১৯২৪ সালে রামচরিত মূল কাব্যটির পাঠ টীকা ছাড়া প্রকাশ করেন। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি থেকে ড: রমেশচন্দ্র মজুমদার, ননীগোপাল বন্দোপাধ্যায় ও রাধাগোবিন্দ বসাক পূর্বের পাঠোদ্ধারের ভুলগুলো সংশোধন করে ইংরেজী ও সংস্কৃতে পুনরায় গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। সর্বশেষ ১৯৫৩ সালে রাধাগোবিন্দ বসাক সমস্ত গ্রন্থখানি বাংলায় পুনরায় প্রকাশ করেন। এই সংস্করণটি এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।

সন্ধ্যাকর নন্দী সমগ্র বাংলার গৌরব। তাঁর জন্ম এই পুণ্ড্রে, এই বরেন্দ্রীতে। তাঁর পিতামহ পিনাক নন্দী একজন বিদ্বানব্যক্তি ছিলেন। তাঁর পিতা প্রজাপতি নন্দী পালরাজ রামপালের সান্ধিবিগ্রহিক।

কবি নিজের জন্মস্থান নিয়ে লিখেছেন:

বসুধাশিরোবরেন্দ্রীমন্ডলচূড়ামণিঃ কুলস্থানং।
শ্রীপৌণ্ড্রবর্দ্ধনপুর প্রতিবদ্ধঃ পূণ্যভূর্বৃহদ্বটু।।

পুণ্ড্রে পৃথিবীর শিরোমণিস্বরূপ বরেন্দ্রের পূণ্যভূমিতে তাঁর জন্ম। জন্মস্থানের কথায় লিখেছেন "বৃহদ্বটু"। এটি তাঁর গ্রামের নামও হতে পারে। আবার প্রসংশাসূচক অভিধা হতে পারে। যে গবেষকগণ রামচরিতের পাঠোদ্ধারে নিয়োজিত ছিলেন, তাঁরা "বৃহদ্বটু" অর্থ যে গ্রামে পণ্ডিতগণের আবাস - এরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ সন্ধ্যাকর নন্দীর গ্রাম ছিল বহু বিদ্বানের আবাসস্থল। গ্রামটি বরেন্দ্রীতে সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। মুষ্টিমেয় কিছু গবেষক ভ্রান্তিবশত "বৃহদ্বটু" গ্রামের অবস্থিতি দক্ষিণ দিনাজপুরের বাটুন গ্রামে মনে করেন, কেবলমাত্র নামের আক্ষরিক সাদৃশ্য দেখে। অথচ বরেন্দ্র বলতে যে ভূখণ্ড বোঝায়, মহাস্থান ও এর চারপাশের এলাকাটি মূখ্য এবং বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা বরেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও কোটীবর্ষ নামে সবসময় পরিচিতি পেয়েছে। এমনকি পাল আমলের সবশেষ শিলালেখ অবধি কোটীবর্ষ নামটি ব্যবহৃত হতে দেখি। সে হিসেবে সন্ধ্যাকর নন্দী নিজের জন্মস্থানের কথা বলতে কোটীবর্ষ লিখতেন, বরেন্দ্রী নয়।

আরেকটি চমকপ্রদ কথা রয়েছে। ১৯১২ সালের দিকে তৎকালীন বগুড়ার ডেপুটি ইন্জিনিয়ার পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাস্থানগড়ের অভ্যন্তরে মানকালির কুণ্ডের পাশে পুরনো পুকুর সংস্কার করার সময় কালো পাথরের একটি শিলালেখ আবিষ্কার করেন। শ্রদ্ধেয় প্রভাসচন্দ্র সেন ১৯১৯ সালে এবং হরিদাস মিত্র ১৯২২ সালে শিলালেখটির পাঠোদ্ধার করেন। দূর্ভাগ্যবশত শিলালেখটি ভঙ্গুর অবস্থায় পাওয়া যায় এবং অনেকগুলো উৎকীর্ণ শ্লোক আর পাওয়া যায় নি। যতটুকু লেখা ছিল তা থেকে পুণ্ড্রে বসবাসকারী যশস্বী নন্দী পরিবারের কথা জানা যায়। বিভূষিত নন্দী ও তাঁর পরবর্তী তিন অধস্তন পুরুষদের কথা রয়েছে শিলালেখ এ। গোপগৃহ গ্রামে ছিল এই নন্দী পরিবারের নিবাস। দানধ্যান ও বিদ্যায় যশস্বী এই নন্দী পরিবার। শিলালেখটির সময়কাল নবম শতাব্দীর শেষ থেকে দশম শতকের প্রথমদিকে; অর্থাৎ সন্ধ্যাকর নন্দী সময় থেকে প্রায় দেড়শো বছরের ব্যবধান। গোপগৃহ গ্রাম পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়) থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বর্তমান গোকুল গ্রামটি, আয়তনে বেশ বড় একটি গ্রাম ও ইউনিয়নের নামও গোকুল। গোকুল গ্রামের কাছেই আরেকটি গ্রামের নাম নন্দীপাড়া [লাহিড়ীপাড়া ইউনিয়ন, বগুড়া]। এই নন্দীপাড়া গ্রামটিই উক্ত নন্দী পরিবারের বাসস্থান হওয়া সম্ভব, স্থাননাম ও শিলালেখ থেকে আমার তেমনই মত। এখনকার ইউনিয়ন পরিষদের সীমারেখা আজ থেকে হাজার বছর আগের মতো ছিল না; গোকুল গ্রাম ও নন্দীপাড়ার সীমারেখাও এ কালে টানা হয়েছে। গোপগৃহ গ্রামে যে পাড়ায় নন্দীদের আবাস, সেটিই নন্দীপাড়া নয় কি? ঘোষপাড়া, কামারপাড়া, বামনপাড়া, সাহাপাড়া, লাহিড়ীপাড়া তো এভাবেই হয়েছে।

মহাস্থান শিলালেখটি যদিও সুস্পষ্টভাবে সন্ধ্যাকর নন্দীর সাথে উক্ত নন্দী পরিবারের সংযোগ প্রমাণ করে না, তারপরেও রামচরিতে সন্ধ্যাকর নন্দীর জন্মস্থান ও বংশ নিয়ে লেখাগুলো ভাবার সুযোগ দেয়। এবং যদি সন্ধ্যাকর নন্দী একই নন্দী পরিবারের অধস্তন পুরুষ হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর "বৃহদ্বটু" গ্রাম উপরে উল্লিখিত নন্দীপাড়া গ্রামটি। এ বিষয়ে খুব একটা সন্দেহের অবকাশ নেই।

তথ্যসূত্র:
১. রামচরিত, ড: রাধাগোবিন্দ বসাক অনূদিত
২. বগুড়ার ইতিহাস, প্রভাসচন্দ্র সেন
৩. Journal of Asiatic Society Bengal, NS XVIII

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)