জয়পুরহাট জেলার ইতিহাস



বরেন্দ্রীর বুকে ছোট্ট একটি জেলা, আমাদের প্রাণের জেলা জয়পুরহাট। মানুষ মাত্রই তার জন্মস্থানের প্রতি একটি আলাদা ভালোবাসা থাকে, যাকে নাড়ির টান বলি আমরা। আমি যেখানেই যাই, লালমাটি চোখে পড়লে মনে পড়ে যায় জয়পুরহাটের মাটি; বরেন্দ্রীর মাটির বিশেষত্ব যে লাল রং।

ভূতাত্ত্বিকগণ বলেন, প্লাইস্টোসিন যুগে, মানে আজ থেকে ২.৫৮ মিলিয়ন থেকে ১১,৭০০ বছর আগে যে সকল ভূমি বা অঞ্চল সমুদ্রতল থেকে উত্থিত হয়েছিল, আমাদের বরেন্দ্রী তার মধ্যে একটি। তার মানে, সমগ্র বাংলার প্রাচীন ভূমি ও জনপদগুলোর মধ্যে আমাদের জয়পুরহাট ও আশেপাশের অঞ্চল অন্যতম। লালরঙের মাটি আর ভূগর্ভস্থ কয়লা ও চুনাপাথরের ভাণ্ডার এ এলাকার প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দেয়।

ঠিক কবে এ অঞ্চলে মানববসতি গড়ে ওঠে তা বলা কঠিন, যেহেতু এখানে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের কোন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় নি। এর একটি কারণ হতে পারে, একই জায়গায় বারবার বসতি স্থাপিত হয়েছে; যার ফলে বেশি প্রাচীন সময়ের নিদর্শন পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন গ্রন্থাবলী থেকে আমরা এ জনপদের নাম পাই পুণ্ড্র বা পৌণ্ড্র বা পৌণ্ড্রবর্ধন হিসেবে, আমরা আলোচনার সুবিধার্থে কেবল পুণ্ড্র নামটি ব্যবহার করবো এখানে। পুণ্ড্রের ভৌগোলিক সীমা আমাদের বুঝতে হবে। আজকের বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সমগ্র উত্তরবঙ্গ পুণ্ড্রের প্রধান অঞ্চল এবং তা বিস্তৃত হয়েছিল ব্যাঘ্রতটী মণ্ডল বা সুন্দরবন পর্যন্ত। কাজেই এটি বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে অবস্থিত ছিল এবং নানা সময়ে এর সীমানা পরিবর্তন হয়েছে। পুণ্ড্রের রাজধানী পুণ্ড্রনগর, যেটি আজকের মহাস্থানগড়। মহামতি সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে পুণ্ড্রনগরের উল্লেখ করা হয়েছে "পুড্ডনগল" নামে। এই পুণ্ড্রনগরকে কেন্দ্র করে সমগ্র পুণ্ড্রে মানববসতির জন্য অসংখ্য নগর, গ্রাম ও ধর্মীয় কেন্দ্র গড়ে ওঠে। জয়পুরহাটের পাথরঘাটা, উঁচাই, বলিগ্রাম, মাত্রাই, ক্ষেতলাল সদর, ছিলিমপুর, বিয়ালা, রায়কালী, দেওড়া, বেল আমলা এ সমস্ত বিস্তৃত অঞ্চলে নদীর তীর ধরে জনবসতি গড়ে ওঠে। সুতরাং আমাদের জয়পুরহাট পুণ্ড্রের একটি প্রধান অংশ ছিল সেটি সুস্পষ্ট।

এই জনপদের আদি বাসিন্দা হিসেবে 'পৌণ্ড্রজাতি'র নাম পাই। কোল, মুণ্ডাসহ অন্যান্য জাতিরও বাস ছিল, যাদের সবার নাম জানা যায় না। ঐতরেয় আরণ্যকে এই জনপদের বাসিন্দাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, "ইমাঃ প্রজাস্তিস্রো অত্যায় মায়ং স্তানীমানি বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চের...."। অর্থাৎ এ জনপদের মানুষেরা "বয়াংসি" বা পাখির মতো দুর্ভেদ্য ভাষায় কথা বলে। "বয়াংসি" কথাটির আরেকটি অর্থভেদ হলো, যারা পাখির উপাসনা করে। আর্যদের কাছে পুণ্ড্রের আদি বাসিন্দারা একটু বিচিত্র মনে হয়েছে, তাদের ভাষা পাখির ভাষার মতো খাপছাড়া অর্থহীন। তাইতো আর্যরা নিজ দেশে ফিরে গিয়ে বলেছে, পুণ্ড্রভূমিতে গেলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তবে আর্যদের এ ভাবনা কেটে গিয়েছিল পরবর্তীতে।

রামায়ণেও পুণ্ড্র দেশের কথা বলা হয়েছে। সে সময় দু'টি পুণ্ড্রদেশ ছিল, একটি আমাদের এই উত্তরবঙ্গ আরেকটি সম্ভবত দক্ষিণ ভারতে। মহাভারতের যুগে পুণ্ড্ররাজ্য মহারাজ পৌণ্ড্রক বাসুদেবের নেতৃত্বে সমগ্র ভারতে একটি প্রধান সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এমন শক্তিশালী রাজ্যের রাজধানী পুণ্ড্রনগরে এসে রাত্রিযাপন করলে তীর্থের পূণ্য পাওয়ার কথা বললো আর্যরা; অর্থাৎ তাদের পুরনো নীতি বদলে গেল। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সংঘটিত হয় আনুমানিক ১৬৮০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। এই যুদ্ধের পর কয়েক শতাব্দীর ইতিহাসে পুণ্ড্র ছিল নিভৃতচারী; হয়তো যুদ্ধের ভয়াবহ ধাক্কা সামলাতে সময় লেগেছিল।

এরপর আমরা পুণ্ড্র নিয়ে অনেক কথা পাই জৈন ও বৌদ্ধদের গ্রন্থাবলীতে। পুণ্ড্রে জৈনধর্ম বেশ শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। জৈনধর্মের একজন প্রধান ভাষ্যকার ভদ্রস্বামী পুণ্ড্রের মানুষ। পাহাড়পুর তথা সোমপুর মহাবিহারে আগে জৈন মন্দির ও বিহার ছিল, এ সম্পর্কে তাম্রশাসন রয়েছে। মহাস্থানগড় (পুণ্ড্রনগর) এ জৈনদের অনেক মন্দির ছিল। জৈনদের একটি শাখা "পৌণ্ড্রবর্ধনীয়" নামে খ্যাতিমান ছিল। যখন বৌদ্ধধর্মের জোয়ার আসলো, সে জোয়ার পুণ্ড্রে জৈন আধিপত্য হটিয়ে বুদ্ধের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলো এবং এই প্রতিষ্ঠা ১৫০০ বছরের বেশি স্থায়ী ছিল। সুমাগধাবদান থেকে জানা যায়, গৌতম বুদ্ধ পুণ্ড্রনগরে এসেছিলেন এবং ধর্মোপদেশ প্রদান করেছিলেন। মহাস্থানের গোকুল মেধ এ ঘটনার স্মৃতিবাহী। পুণ্ড্রনগরের সাথে সমগ্র পুণ্ড্রে তখন বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার। এ সবই খ্রীষ্টের জন্মের অন্তত ৪৫০ বছর আগের ঘটনা।

এতক্ষণ যা বললাম সবই প্রাচীন গ্রন্থাবলীর আলোকে, পাথুরে প্রমাণ নেই এগুলোর। ঘটনাবলীও তো কম পুরোনো নয়। এখন থেকে পাথুরে প্রমাণের কাল শুরু হলো। মৌর্যযুগ [৩২২ - ১৮৫ খ্রীষ্টপূর্ব] শুরু হলো, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রতিষ্ঠা করলেন সুবিশাল সাম্রাজ্য, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যগুলির একটি। চন্দ্রগুপ্তের সুযোগ্য বংশধর সম্রাট অশোক ২৬১ খ্রীষ্টপূর্বে কলিঙ্গ আক্রমণ করে তা জয় করেন। ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের একটি এই কলিঙ্গ যুদ্ধ, যা অশোকের জীবনও বদলে দেয়। এ যুদ্ধে অনেক বড় ক্ষতির শিকার হয় কলিঙ্গের কৈবর্ত জাতিরা। তারা দলে দলে বাস্তুচ্যুত হয়ে পুণ্ড্রে চলে আসে। এভাবে কৈবর্তরা এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র হয়ে যায়। মনে রাখা দরকার, সাঁওতালরা পুণ্ড্র-বরেন্দ্রে আসে আরো পরে।

মৌর্যযুগে পুণ্ড্রের গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পায়। জয়পুরহাট ও আশেপাশের অঞ্চল বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার, বিশেষত ধান ও আলুর জন্য। সম্রাট অশোকের সময়ও এ অঞ্চলটি ছিল স্বর্ণপ্রসবা, প্রচুর ফসল ফলতো। আমরা অশোকের মহাস্থান শিলালেখ থেকে জানতে পারি, প্রাকৃতিক দূর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ 'সবঙ্গীয়'দের খাদ্য ও অর্থ সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সম্রাট অশোক। যখন দূর্যোগ কেটে যাবে, তখন শস্যভাণ্ডার আবারো পূরণ করে রাখতে বলা হয়েছে। এই সবঙ্গীয়রা সম্ভবত পুণ্ড্রের পাশের কোন জনপদ ছিল, ঠিক যেমন বঙ্গ ও উপবঙ্গ নামের জনপদের কথা জানা যায়। এই মৌর্যযুগে পুণ্ড্রের নানা স্থানে বৌদ্ধ স্তুপ ও মন্দির গড়ে ওঠে। সম্রাট অশোক তাঁর সমস্ত সাম্রাজ্যজুড়ে ৮৪ হাজার স্তুপ নির্মাণ করিয়েছিলেন। পুণ্ড্রনগরের যেখানে বুদ্ধ অবস্থান করেছিলেন, সেখানে একটি সুবিশাল স্তুপ নির্মাণ করেন অশোক। আবার মহাস্থানগড়ের সীমানা প্রাচীরে অনেক নিচের স্তরে মৌর্য, এমনকি মৌর্য-পূর্ব সময়কালের নির্মাণের নমুনাও পাওয়া গিয়েছে। জয়পুরহাটের তুলসীগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে পাথরঘাটা ও এর আশেপাশে নগরীর পত্তন হয় এ সময়ে। আমরা গ্রীকদের বিবরণে পেন্টাপোলিস বা পঞ্চনগরী নামক বাণিজ্যিক বন্দরের কথা জানা যায় এবং পাথরঘাটা সম্ভাব্য পঞ্চনগরী হওয়ার তালিকায় একদম প্রথমদিকে। পঞ্চনগরী থেকে পণ্যবাহী নৌকা দিয়ে পিপুল, উৎকৃষ্ট কাপড়, গুড় ইত্যাদি পণ্য রপ্তানী হতো দূরদেশে। পাথরঘাটার পাশাপাশি বেল আমলা, ক্ষেতলাল সদর, ছিলিমপুর, বিয়ালা, মাত্রাই, বলিগ্রাম ও দেওড়া - এ সমস্ত অঞ্চলেও সমৃদ্ধি আসে। এই সবগুলো জায়গা নদীর তীরবর্তী। তাই কেবল ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বাণিজ্যিক কার্যক্রমও এ সমস্ত জায়গা থেকে পরিচালিত হতো। আমি এ সমস্ত জায়গায় পুরনো নদীখাত দেখেছি।

মৌর্যযুগের অবসানের পর পুণ্ড্রের ইতিহাস আবারো কয়েকশো বছর নিশ্চুপ। এ সময়কালের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন মহাস্থানগড়ে পাওয়া গেলেও ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি সুস্পষ্ট ছিল না। মহাস্থানগড় থেকে অসংখ্য শুঙ্গ যুগ [১৮৫ - ৭৮ খ্রীষ্টপূর্ব] ও কুষাণ যুগের [৩০ - ৩৭৫ খ্রিষ্টাব্দ] নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। মূলত কুষাণ যুগের শিল্পরীতি এ অঞ্চলকে বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করেছিল। সমগ্র পুণ্ড্রে এ যুগের প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, বিশেষ করে নানা রকমের পাথরের মূর্তি ও মুদ্রা। জয়পুরহাটের অনেক স্থানে কুষাণ যুগের মুদ্রা ও নিদর্শন পাওয়ার কথা জানা যায় প্রাচীন বিবরণ থেকে, যদিও সেগুলো আজকে কোথায় আছে বলা মুশকিল। সুতরাং এই দীর্ঘ সময়কাল সমগ্র অঞ্চলে জীবনপ্রবাহ বজায় ছিল।

কুষাণ যুগের অবসানে শুরু হয় গুপ্তযুগ [৩২০ - ৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ], ইতিহাসে ধ্রুপদী যুগ বলা হয় যে সময়টাকে। গুপ্তযুগে পুণ্ড্রের ইতিহাস আবারো সরব হয়ে ওঠে। রাজনীতি, ধর্ম, শিল্প-সংস্কৃতি, সাহিত্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে নতুনত্বের জোয়ার আসে। গুপ্ত সম্রাটদের প্রশাসনিক কাঠামোয় পুণ্ড্রবর্ধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল এবং তাঁদের এ অঞ্চলের রাজধানী ছিল পুণ্ড্রনগর। এ সময় পুণ্ড্রে কয়েকটি 'বিষয়' বা প্রশাসনিক কেন্দ্র [সহজে ভাষায়, আজকের বিভাগীয় ধারণার মতো] ছিল, যার দুটি হলো পঞ্চনগরী ও কোটীবর্ষ। বৈগ্রাম তাম্রশাসন, দামোদরপুর তাম্রশাসন ও পাহাড়পুর তাম্রশাসনে পঞ্চনগরীর নাম পাই। খুব সহজ ভাষায় বললে, তাম্রশাসন হলো তামার পাতে লেখা রাজার আদেশ বা দলিল। বৈগ্রাম, দামোদরপুর ও পাহাড়পুরে প্রাপ্ত এই তাম্রশাসনগুলোতে ভূমি ক্রয়-বিক্রয় ও মন্দিরের জন্য সে ভূমিদানের কথা বলা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটি পঞ্চনগরী বিষয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আগেই বলেছি, পঞ্চনগরীর সম্ভাব্য অবস্থান জয়পুরহাটের পাথরঘাটা। আমরা পাথরঘাটার যে পাথরের সেতুর ভগ্নাবশেষ দেখি, সে সেতুটি গুপ্ত যুগে নির্মিত হয়। পাথরঘাটা গুরুত্বপূর্ণ না হলে এখানে এমন সেতু নির্মাণ হতো না। তুলসীগঙ্গা নদীর দু'পাশে নগর গড়ে উঠেছিল এবং দুই পাশের নগরকে সেতু দিয়ে যুক্ত করা হয়েছিল যাতায়াতের সুবিধার জন্য। পাথরঘাটার যত বিশাল জায়গা জুড়ে পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা রয়েছে এবং আরো অনেক ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, তা থেকে এ নগরের আয়তন সহজেই অনুধাবন করা যায়। এর পাশাপাশি জয়পুরহাটের বেল আমলা, ক্ষেতলাল সদর, মাত্রাই, বলিগ্রাম, বিয়ালা, ছিলিমপুর ও দেওড়াসহ সমগ্র পুণ্ড্রে অসংখ্য মন্দির ও বিহার স্থাপিত হয়। বলিগ্রামে একসময় ২০ টির বেশি ঢিবি ছিল, পরিধিও বিশাল। দেওড়া গ্রামের প্রত্নস্থানের ব্যাপ্তি বিরাট, সেই রায়কালী পর্যন্ত পাওয়া যায়। এ সমস্ত স্থাপনার উপরে পরবর্তীকালে পাল আমলের স্থাপনাগুলো গড়ে উঠেছিল। পুরাতাত্ত্বিক খননে বেশিরভাগ সময়ই এ বিষয়টি দেখা যায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. স্বাধীন সেনের নেতৃত্বে একদল প্রত্নতাত্ত্বিক জয়পুরহাট ও দিনাজপুরে জরিপ পরিচালনা করে ৬৬ টি স্থানে খ্রিষ্টীয় ৭ম থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত সময়কালের মানব বসতির সন্ধান পেয়েছেন। জয়পুরহাটের কালাই, ক্ষেতলাল ও পাঁচবিবির পাথরঘাটা সংলগ্ন এলাকায় এ জরিপ পরিচালিত হয়েছিল। এ জরিপের রিপোর্ট থেকে বলা যায়, গুপ্তযুগ থেকে জয়পুরহাটের এ এলাকাগুলোতে মানব বসতির গবেষণালব্ধ প্রমাণ বিদ্যমান। গুপ্তযুগের আলোচনা অনেক দীর্ঘ, তাই এখানে সংক্ষেপে বলতে হচ্ছে সবার যাতে ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে।

দীর্ঘ গুপ্তযুগের অবসানে ক্ষমতায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব মহারাজ শশাঙ্কের [আনুমানিক ৫৯০ - ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ]। এ সময়ই সমগ্র উত্তরবঙ্গ "গৌড়" হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। পুণ্ড্র নামটি রয়ে যায় প্রশাসনিক কাঠামোয়। পুণ্ড্রে প্রচুর আখ উৎপন্ন হতো, খুব উৎকৃষ্টমানের আখ। এই আখ থেকে তৈরী হতো উৎকৃষ্টমানের গুড়, যা নদীপথে চলে যেত নানা দেশে। পুণ্ড্রের সব গুড় এসে জমা হতো গঙ্গার ধারে একটি স্থানে এবং এই স্থান থেকে চালান হতো দূরদেশে। গুড় থেকে সে জায়গার নাম হলো গৌড়। শশাঙ্ক ও পরবর্তী শাসকদের অনেকেই নিজেদের গৌড়ধিপ, গৌড়নৃপ, গৌড়াধিপতি প্রভৃতি উপাধি ধারণ করতেন। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে এ অঞ্চলের অরাজকতা দেখা দেয় রাষ্ট্রযন্ত্রে, যা ইতিহাসে "মাৎসন্যায়" হিসেবে পরিচিতি। মাৎসন্যায় হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে জলাশয়ের বড় মাছ ছোটমাছদের খেয়ে ফেলছে।

প্রায় একশ বছরের মাৎসন্যায় কালের অবসান হয় পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ গোপালদেবের গৌড়ের সিংহাসনে বসার মধ্যদিয়ে। সমস্ত বাংলার ইতিহাসে পালযুগ [৭৫০ - ১১৬১ খ্রিষ্টাব্দ] সবচেয়ে বেশি সময়, ৪০০ বছর টিকে ছিল। এ যুগে স্থাপত্য, শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উৎকর্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। পাল আমলে শাসন ব্যবস্থায় অনেকগুলো রাজধানী পাওয়া যায়, যেগুলোকে বলা হতো 'জয়স্কন্ধাবার', যেগুলো অনেকটা সেনা ছাউনীর মতো। রাজা প্রয়োজনানুসারে একেক সময় একেক রাজধানীতে অবস্থান করে শাসনকার্য চালাতেন। পুণ্ড্রনগর তখনো অন্যতম প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং পাশাপাশি ধর্মচর্চার কেন্দ্র হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছিল। জয়পুরহাটে দু'টি এ রকম জয়স্কন্ধাবার খোঁজ মিলেছে এ পর্যন্ত। একটি পাথরঘাটার সন্নিকটে মহীপুর [প্রথম মহীপালের নামানুসারে] এবং আরেকটি দেবগ্রাম [এখনকার দেওড়া গ্রাম]। বাদাল স্তম্ভ বা ভীমের পান্টির গায়ে লেখা রয়েছে,... দেবগ্রামভব তস্য পত্নী বব্বাভিধাহভবৎ....। অর্থাৎ দেবগ্রামের বব্বাদেবীকে পাল সম্রাট শুরপাল বিবাহ করেছিলেন। আরো জয়স্কন্ধাবার ছিল কিনা সেটি গবেষণার দাবী রাখে।

পাথরঘাটা তো রীতিমতো প্রশাসনিক ও বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল এবং এখানে বৌদ্ধবিহার অথবা বিহারগুচ্ছ ছিল, যেমন উঁচাই ঢিবি একটি সম্ভাবনাময় প্রত্নস্থল। বেল আমলা গ্রামে ক্ষুদ্র বিহার ছিল বলে মনে করি, সেখানকার বাজারের নিকটস্থ এক মন্দির বা এক শিবালয়ের বিপরীতের জমিতে লম্বা ইটের প্রাচীর, ঘরের কাঠামো আমি বহুবার দেখেছি। এখন সেখানে কৃষিকাজ হয়। এর পাশাপাশি বেল আমলায় অনেকগুলো মন্দির ও স্তুপ ছিল, যেগুলোর ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখা যায়। বলিগ্রাম, মাত্রাই, ছিলিমপুর ও বিয়ালা গ্রামগুলোতে গভীর নিরীক্ষা করলে বৌদ্ধ বিহারের সন্ধান পাওয়া যাবে। বলিগ্রামের বিষয়ে আমি ভীষণ আত্মবিশ্বাসী, আমার ক্ষেত্রসমীক্ষা থেকে আমি এ কথা বলছি। বিয়ালা ও মাত্রাই এ অতি গুরুত্বপূর্ণ দুটি লেখ পাওয়া যায়, বিয়ালা থেকে পালরাজ প্রথম মহীপালদেবের তাম্রশাসন এবং মাত্রাই থেকে বালাদিত্যের শিলালেখ এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ অতীতের সুস্পষ্ট প্রমাণ। ক্ষেতলাল থানার পাশে রাজবাড়ীর ভিটা থেকে আলেকজান্ডার কানিংহাম একটি ভগ্ন বৌদ্ধ মূর্তি পেয়েছিলেন, যার পাদদেশে লেখা ছিল, তা হলো: "ইয়ে ধর্ম্মহেতু প্রভাহেতু তেষাং *****"। বাকী লেখাটুকু পাওয়া যায় নি। এ কথা কয়টি বৌদ্ধধর্মের সাথে সম্পর্কিত। বেল আমলা গ্রামে একটি চতুর্ভুজা তারাদেবীর মূর্তি পাওয়া যায়, যার পাদদেশে ”রাজ্ঞী শ্রীগীতা তারা” কথাটি উৎকীর্ণ করা ছিল। কোন রাজমাতা বা তদ্রুপ গুরুত্বপূর্ণ নারী সূদুর অতীতে এই তারা মূর্তি স্থাপন করিয়েছিলেন এখানে নিজের নাম অমর করে রাখতে। ছোট যমুনা নদীর তীরে জয়পাল রাজার বাড়ি নামে একটি বিরাট প্রত্নস্থান ছিল, যেটি মূলত কোন মন্দির ও সংলগ্ন বিহারের ধ্বংসাবশেষ। মাত্রাই গ্রামেও অনেক প্রাচীন ঢিবি ছিল, এর কয়েকটি ঢিবি থেকে নব্বইয়ের দশকে বেশ কয়েকটি মূল্যবান প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছিল, বিশেষ করে পাল শিল্পরীতির পাথরের মূর্তি। কেন্দুল গ্রামে অনেক প্রত্নবস্তু পাওয়া যায় - মৃৎপাত্রের অংশ, মাটির বল, প্রাচীন ইটের ভগ্নাংশ ইত্যাদি। মজার বিষয়, জয়পুরহাট সদরের কয়েক কিলোমিটার দূরে উঁচু চক [স্থানীয় ভাষায় উঁচা চক] একটি বড় পুকুরের পাড়ে ইট ও খোলামকুচিপূর্ণ প্রায় সমান হয়ে আসা ঢিবি খুঁজে পেয়েছি। এখানে মাটির প্রদীপ, মৃৎপাত্র, পোড়ামাটির খেলনা ইত্যাদি পাওয়া যেত বলে স্থানীয়রা বলেছেন। উঁচা চক থেকে তুলসীগঙ্গা নদীর দূরত্ব সামান্যই। সুতরাং এখানে যে কোন বৌদ্ধ স্তুপ বা মন্দির ছিল সেটি ধরে নেয়া যায়। এতক্ষণ যে কয়েকটি জায়গার কথা বললাম সবগুলোতেই বেশি সংখ্যায় পুকুর, প্রাচীন ও বৃহৎ দীঘি, চাষের জমিতে ইট ও খোলামকুচির উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। পাল যুগে জয়পুরহাটের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষ্য এ সব কিছু। পাল যুগে এসে জয়পুরহাট ও এর আশেপাশের বিস্তৃত অঞ্চলের আরেকটি নাম পাওয়া যায় বরেন্দ্র বা বরেন্দ্রী। পালরাজদের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দীর "রামচরিত" থেকে জানা যায়, বরেন্দ্রভূমি পাল রাজাদের "জনকভূ" মানে পিতৃভূমি। তার মানে, গোপাল - ধর্মপাল - দেবপাল বরেন্দ্রের মানুষ। পাহাড়পুর (সোমপুর মহাবিহার) থেকে ৭/৮ কিলোমিটার দূরে জয়পুরহাটের প্রাচীন একটি গ্রাম গোপালপুর। মুসলমান ও কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস গ্রামটিতে। গোপালদেবের স্মৃতিতে গ্রামের নাম গোপালপুর কিনা বলতে পারি না। সোমপুর মহাবিহারের বাইরের প্রাঙ্গনে সত্যপীরের ভিটা আর খোদ পাহাড়পুরের আরেক নাম 'গোপাল চিতার পাহাড়'। এখান থেকে আরো ১৭ কিলোমিটার এগিয়ে যোগীর ঘোপা, যেখানে দেবপালের সমাধি আছে বলে প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিকগণ বলেছেন। সুতরাং পালদের সঙ্গে বরেন্দ্রীর সম্পর্ক বেশ গভীর। পালযুগ নিয়ে আরো অনেক বিস্তারিত আলোচনা হতে পারে, তবে এখানে আর নয়; পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি হবে। আমরা পরের যুগ, মানে সেনযুগে যাওয়ার আগে জয়পুরহাট জেলার নামকরণ নিয়ে কথা বলছি, কারণ এখানেও পালযুগের সংযোগ আছে। জয়পুরহাট জেলার সদর থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে "জয়পাল রাজার বাড়ি" নামে একটি বিশাল ঢিবি ছিল, এখন খুব সামান্য অবশিষ্ট আছে। ঢিবিটির পূ্র্ব পাশ দিয়ে চিরি নদী [ছোট যমুনার পুরনো খাত] এবং পশ্চিম দিক দিয়ে ছোট যমুনা নদীর বর্তমান খাতটি বয়ে চলেছে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, জয়পাল রাজার নামানুসারে 'জয়পুরহাট' নামটি হয়েছে। এ অঞ্চলের ইতিহাসে জয়পাল নামের কোন রাজার নাম পাওয়া যায় না। তবে রাজা না হয়েও ইতিহাসে একজন জয়পালের নাম প্রসিদ্ধ। নারায়ণপালদেবের ভাগলপুর তাম্রশাসনে পাই: ***** পুত্রো বভূব বিজয়ী জয়পালনামা। ধর্মদ্বিষাং শময়িতা যুধি দেবপালে। **** পালসম্রাট দেবপালের কনিষ্ঠ ভ্রাতা জয়পাল, যাঁর বীরত্বের দ্বারা দেবপাল প্রাগজ্যোতিষপুর বা কামরূপ ও অন্যান্য অনেক রাজ্য জয় করেন। বরেন্দ্রী পেরিয়ে কামরূপ পৌঁছানো যায়। আরো মজার ব্যাপার, দেবপালের পর তাঁর পুত্র শূরপাল ও মহেন্দ্রপালের পর দেবপালের পরের বংশধর নয়, বরং জয়পালের বংশধরেরা সিংহাসন পায় এবং শেষ পাল রাজা পর্যন্ত সবাই জয়পালের বংশধর। তাই নিজে রাজা না হয়েও পাল শাসনামলে জয়পাল চিরস্মরণীয় হয়ে ছিলেন। জয়পালের নামানুসারে জয়পুর, পরে তা জয়পুরহাট হয়। এখনো জয়পাল রাজার বাড়ি থেকে ২/৩ কিলোমিটার দূরে বেশ বড় একটি গ্রাম রয়েছে, যার নাম উত্তর জয়পুর। হয়তো জয়পালের কোন বীরত্বের ঘটনার পরে এ জায়গা জয়পালের নামে পরিচিত পায়। আমার এ মতের পেছনে আরেকটি যুক্তি রয়েছে। প্রথম মহীপালদেবের প্রতিষ্ঠিত জয়স্কন্ধাবার পাথরঘাটার পাশে মহীপুর, একথা আগে বলেছি। এই পাল সম্রাটের নাম বরেন্দ্রীর বুকে অমর হয়ে রয়েছে তাঁর সুশাসনের জন্য। "ধান ভাঙ্গতে মহীপালের গীত" একটি প্রবাদ বচন। শ্রদ্ধেয় দীনেশচন্দ্র সেন "মহীপালের গীত" সংগ্রহ করেছিলেন। এই মহীপালদেবের একটি তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ের রাজভিটা নামক স্থানে। তাম্রশাসনটি বাংলার ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই সাথে বেশ ব্যতিক্রমধর্মী দলিল। এটি নিয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই এখানে। কেবল এটুকু অতি সংক্ষেপে বলা যায়, তাম্রশাসনটি একটি দেবোত্তর সম্পত্তির বন্দোবস্ত (ইজারা) দেওয়ার জন্য তিনটি হট্ট [বাজার/হাট] এর ব্যবসায়ী সংগঠনের সাথে চুক্তিপত্র হিসেবে লেখা হয়েছিল। এই তিনটি হট্ট বা বাজার হলো গৌড়হট্ট, জয়হট্ট ও দেশীহট্ট। গৌড়হট্ট তো নাম থেকেই বোঝা যায়, এটি গৌড়ের কোন হাট। দেশীহট্টের সন্ধান জানা যায় নি এখনো। জয়হট্ট তাহলে কোনটি? জয়হট্ট > জয়হাট > জয়পুরহাট হতে পারে কি? জয়পুরহাটের বর্তমান অবস্থা বিচার করলেও কিন্ত অনেকগুলো বড় হাট পাওয়া যায়, অন্য অনেক বড় জেলার চেয়ে হাটের সংখ্যা বেশিই বটে। প্রতিনিয়ত আমদানি-রপ্তানি চলে এগুলোতে। উত্তর জয়পুর নামে গ্রাম তো আগে থেকেই ছিল; তাহলে জয়হট্ট জয়পুরহাটের নামান্তর হওয়া ভীষণ সম্ভব। সংশ্লিষ্ট গবেষকগণ এ নিয়ে গবেষণা করলে সদুত্তর পাওয়া যাবে। অনেকে বলে, জয়পুরহাটে বিংশ শতকের শুরুতে আগত মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় তাদের পিতৃভূমি জয়পুর এর স্মৃতিচারণ করে এই এলাকার নাম রাখেন 'জয়পুর'। পরে বৃটিশ আমলে রেল স্টেশন স্থাপনের সময় জয়পুর ও রাজস্থানের জয়পুরের একই নাম হওয়ায় আমাদের 'জয়পুর' এর সাথে 'হাট' যুক্ত করে 'জয়পুরহাট' রাখা হয়। এ কথাটি একেবারেই ভুলভাল। মাড়োয়ারিদের আসার বহু শতাব্দী আগেও জয়পুর নামের অস্তিত্ব ছিল। উপরের অনুচ্ছেদে সে বিষয়ে যথেষ্ট আলোকপাত করেছি। পালযুগের অবসানে পুণ্ড্র-বরেন্দ্রের ভাগ্যরবি পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়তে শুরু করে। সেন আমলে পুণ্ড্রের চেয়ে গৌড় ও পরে বিক্রমপুর বেশি গুরুত্ব পায়। পুণ্ড্রের নানা স্থানে মন্দির নির্মিত হতে থাকে কেবল। পুণ্ড্রনগর প্রসাশনিক কেন্দ্রের চেয়ে ধর্মীয় কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বরেন্দ্রীর অন্য অঞ্চলও তথৈবচ। 

[বাকী পর্ব শীঘ্রই দেয়া হবে] 


Joypurhat District [Photo: Wikipedia]

Comments

  1. এই পেজে/গ্রুপে যুক্ত হতে চাই

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি আমাদের ফেসবুক পেইজে যুক্ত হতে পারেন:

      https://www.facebook.com/shahriar.scrapbook?mibextid=ZbWKwL

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)