একটু খেজুরে আলাপ

সৈয়দ মুজতবা আলীর "রসগোল্লা" গল্পটি তো সবাই পড়েছেন। ইতালির ভেনিস বন্দরে চুঙ্গিওলার নাকে রসগোল্লা থেবড়ে দেওয়া এবং অতঃপর রসগোল্লার জাদুতে সবাই বিভোর হয়ে যাওয়ার গল্পটি আমাদের এখনো হাসায়। সেই সঙ্গে বাঙালি হিসেবে রসগোল্লা নিয়ে গর্ববোধ হয়, বিশেষত আমার মতো মিষ্টান্ন প্রেমিকদের জন্য। রসগোল্লার পাশাপাশি আর যে মিষ্টিগুলো আমাকে বেশি টানে, খেজুর গুড়ের জিলাপি তার মধ্যে অগ্রগণ্য। পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীতে যখন শীত নামতে শুরু করে, সেসময় এই জিলাপি যেন অমৃত সমান। আহা, খেজুর গুড়ের জিলাপির প্যাঁচে যেন আটকে পড়েও সুখ। 


খেজুরের জিলাপি

পুণ্ড্রে শীত নামতে শুরু করলে গুড়ের জিলাপির চাহিদা বাড়তে থাকে। রসে ভরা প্যাঁচওয়ালা বস্তুটির যেন একটা সম্মোহনী ক্ষমতা আছে; আমার মতো মিষ্টান্ন প্রিয় মানুষের অন্তত সে কথাই মনে হয়। সে ভাবনা থেকে একদিন খেয়াল হলো, খেজুর গুড় নিয়ে কিছু সুলুকসন্ধান করা দরকার, যে গুড়ের মহিমায় জিলাপির প্যাঁচে পড়েও খুশি আমি। এই খেজুরে আলাপ সে কারণেই করছি। 


পুণ্ড্রের আখ ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত একথা আমরা জানি। অতি প্রাচীন এ অঞ্চলের বাসিন্দা পুণ্ড্রগণ আখচাষে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। পুণ্ড্রে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ আখের খ্যাতির কারণে এখানকার আখের নাম হয়েছিল "পৌণ্ড্রক" বা "পুঁড়ি" আখ। সুশ্রুত সংহিতায় ইক্ষুর কয়েকটি প্রকার বা জাতের নাম বলা হয়েছে: পৌণ্ড্রক, ভীরুক, বংশক, শতপোনক, কান্তার, তাপসেক্ষু, কাষ্ঠেক্ষু, সূচিপত্র, নৈপাল, দীর্ঘপত্র, নীলপোর এবং কোশকৃৎ। পৌণ্ড্রক ইক্ষু অতি উৎকৃষ্ট মানের, এর রসকে বলা হয়েছে "সুশীতল, মধুর, স্নিগ্ধ, বৃংহণ, শ্লেষ্মবহুল, সারক অবিদাহী, গুরু ও তেজষ্কর"। বহু রোগের উপশমে আখের রস ও গুড় ব্যবহারের কথা রয়েছে সুশ্রুত সংহিতা জুড়ে। সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিতে পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীর কৃষিসম্পদের মধ্যে অপরিমিত আখের কথাও বলেছেন:

বহুধান্যরাজসংহতিসংভাবিতকাম্যরূপয়া লক্ষ্যা।
সদ্বংশাস্তারিতয়া প্রস্ফুরদিক্ষ্বাকুশেখরাভরণম।। ৩/১৭

অর্থাৎ সেই বরেন্দ্রী পৃথিবীর শিরোভূষণ রূপে বিরাজ করছিলো, কারণ এর সম্পত্তির কমনীয় স্বরূপ নানা ধরণের বিপুল পরিমাণের ধান, উত্তম বেণুসমূহ দ্বারা প্রসারিত ছিল এবং দীপ্তিযুক্ত আখ দ্বারা শোভিত ছিল।

আবার সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থে রয়েছে:

ব্রীহিঃ স্তম্বকারিঃ প্রভূত পয়সঃ প্রত্যাগতা ধেনবঃ
প্রত্যুজ্জীবিতমিক্ষুণা ভূশমিতি ধ্যায়ন্ন পেতান্যধীঃ।
সান্দ্রোশীর কুটুম্বিনী স্তনভর ব্যালুপ্তঘর্মক্লমো।
দেবে নীরমুদারমুজ্ঝতি সুখং শেতে নিশাং গ্রামণীঃ৷ 

প্রচুর জল পেয়ে ধান চমৎকার গজিয়ে উঠেছে, গরুগুলি ঘরে ফিরে এসেছে; ইক্ষুর সমৃদ্ধিও দেখা যাচ্ছে; তাই আর অন্য কোনও ভাবনা নেই। ঘর্মক্লান্তিমুক্ত স্ত্রীও ঘরে এই অবসরে উশীর প্রসাধন করছে; বাহিরে আকাশ হতে প্রচুর জল ঝরছে, গ্রাম্য যুবক সুখে শুয়ে আছে।

পুণ্ড্রে উৎপাদিত এই বিপুল পরিমাণ আখ থেকে তৈরী হতো উৎকৃষ্টমানের গুড়, যা চলে যেত দেশ-দেশান্তরে। সমস্ত পুণ্ড্রবর্ধনে উৎপাদিত গুড় এসে জমা হতো গৌড়ে, তারপর সেখান থেকে নানা দেশ ও জনপদে। হাজারো বছরের ইতিহাস এটি। গুড় থেকে গৌড় নামটি এসেছে। শ্রদ্ধেয় ড. নীহাররঞ্জন রায়ও এমনটাই মত দিয়েছেন। 


Tayler, William, Artist. Bengal - "Passees or Toddy Walas". India, 1842.


গুড় জ্বাল দেওয়ার সুগন্ধে আমোদিত হতো গ্রামগুলো। সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থে রয়েছে হেমন্তের গ্রামবাংলার অসাধারণ বর্ণনা:

শালিচ্ছেদ-সমৃদ্ধ হালিকগৃহাঃ সংসৃষ্ট-নীলোৎপল
স্নিগ্ধ-শ্যাম-যব-প্ররোহ-নিবিড়ব্যাদীর্ঘ-সীমোদেরাঃ।
মোদন্তে পরিবৃত্ত-ধেন্বনডুহচ্ছাগাঃ পলালৈনবৈঃ
সংসত্তা-ধ্বনিদিষ্ণু যন্ত্রমুখরা গ্ৰাম্য গুড়ামোদিনঃ৷ 

অর্থাৎ, কৃষকের বাড়ি কাটা শালিধানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে; গ্রাম সীমান্তের ক্ষেতে যে প্রচুর যব হয়েছে তার শীষ নীলোৎপলের মতো স্নিগ্ধ শ্যাম; গরু, বলদ ও ছাগগুলি ঘরে ফিরে এসে নতুন খড় পেয়ে আনন্দিত; অবিরত ইক্ষুযন্ত্র ধ্বনিমুখর; গ্রামগুলি নতুন গুড়ের গন্ধে আমোদিত।


খেজুর গুড়

বরেন্দ্রীর অনেক জায়গায় উনবিংশ শতকে স্থানীয়ভাবে তৈরী হতো "লাল" চিনি বা "পেটি" চিনি। শ্রদ্ধেয় কাজী মোহাম্মদ মিছের তাঁর "বগুড়ার ইতিকাহিনী" বইয়ে  লিখেছেন, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর ও পাঁচবিবির কয়েকটি গ্রামে প্রস্তুত হতো এই চিনি। প্রস্তুত প্রণালী এরূপ: ফিটকিরি, নদী বা পুকুরের শ্যাওলা ও স্থানীয় ক্ষারীয় মাটির পুট দিয়ে আখের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরী করা হতো। সে গুড় হামানদিস্তা দিয়ে বারবার পেষণ করে ও ছেঁকে তৈরী করা হতো চিনি। এতদঞ্চলে এই দেশীয় চিনির খুব সমাদর ছিল। আধুনিক চিনি তৈরীর কল আসার পর ধীরে ধীরে এই দেশীয় শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যায়। 


পুণ্ড্রে আখের পাশাপাশি খেজুরগাছও কিন্তু সরবে উপস্থিত। ধর্মপালদেবের তাম্রশাসনে আমরা পাই, "...গঙ্গিনিকা উত্তরেণ কাদম্বরীদেবকুলিকা খর্জুর বৃক্ষশ্চ"। সন্ধ্যাকরনন্দীর রামচরিতেও খেজুর গাছের কথা পাই। আজো এ অঞ্চলে হেলায় বেড়ে ওঠা বৃক্ষরাজির মধ্যে খেজুরগাছের সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। তাই এটি ধরে নেয়া যায়, অতি প্রাচীনকাল থেকে পুণ্ড্রের শোভা বাড়াতো খেজুরগাছ। কেবল কি শোভা, এ জনপদের মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও মিশে গিয়েছিল এ গাছের রস ও ফল। 


পুণ্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চলে খেজুর গুড়ের সুখ্যাতি সবচেয়ে বেশি নাটোর জেলার, অনেক বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এখানে খেজুর গুড় উৎপাদিত হয়। ছেলেবেলা থেকে দেখে এসেছি নাটোর স্টেশন ও আব্দুলপুর জংশনে খেজুর গুড়ের আধিক্য আর মানুষের কেনার হিড়িক। অবশ্য বরেন্দ্রীর অন্যান্য জায়গায়ও যথেষ্ট খেজুর ও আখের গুড় উৎপাদিত হয় এবং স্থানীয় চাহিদার অনেকটাই মেটায়। 


ই-ৎসিঙ্ সপ্তম শতকে নালন্দায় আসেন এবং এতদঞ্চলের অনেক কথা লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায়, নালন্দায় বৌদ্ধভিক্ষুগণ নানা রকমের পান বা সরবৎ পান করতেন। এগুলো হলো চোচ-পান, মোচ-পান, কুলক-পান, অশ্বত্থ-পান, খর্জুর-পান, পরুসক-পান ইত্যাদি। খর্জুর-পান হলো খেজুরের রস। বিনয় পিটকের মহাবগ্গ বা মহাবর্গে তথাগত বুদ্ধ তাঁর শিষ্যগণকে পানীয় সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছেন এভাবে:

"হে ভিক্ষুগণ! আমি অনুজ্ঞা করিতেছি: অষ্টবিধ পানীয় যথা – আম, জাম, বন্যকদলী, গ্রাম্যকদলী, মধু, আঙ্গুর, শালুক এবং খর্জুর [অন্য অনুবাদে দাড়িম্ব] ইত্যাদির রস পান করিতে পারিবে।"
"হে ভিক্ষুগণ! আমি অনুজ্ঞা করিতেছি: ধান্যের রস ব্যতীত সমস্ত ফলের রস পান করিতে পারিবে।"
"হে ভিক্ষুগণ! আমি অনুজ্ঞা করিতেছি: মধুক পুষ্প [মহুয়া ফুল] এর রস ব্যতীত সমস্ত পুষ্পের রস পান করিতে পারিবে।"
"হে ভিক্ষুগণ! আমি অনুজ্ঞা করিতেছি: ইক্ষুর রস পান করিতে পারিবে।"

দেখা যাচ্ছে, ইক্ষু ও খেজুর রস পানের অনুমতি তথাগত বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের দিয়েছেন। 
যদি সে সময় থেকেই খেজুর রস পানের প্রচলন হয়ে থাকে, তাহলে সে রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরী করার কৌশল কি পুণ্ড্রবাসী জানতো না? অবশ্যই জানতো, যার প্রমাণ পুরাণাদি গ্রন্থসমূহে রয়েছে। 


কালিকা পুরাণে নৈবেদ্য হিসেবে যে সমস্ত খাদ্যের তালিকা দেয়া আছে, সেখানে খেজুরের কথা পাই এভাবে: 

মোদকৈঃ পিষ্টকৈঃ পেয়ৈর্ভক্ষ্যভোজ্যৈরনেকশঃ।
কুষ্মাণ্ডৈর্ন্নারিকেলৈশ্চ খর্জুরৈঃ পনসৈস্তথা।। (৬০/৪৬)
বকুলঞ্চ মধুকঞ্চ রসালাম্রতকেশরম্।
আক্ষোড়ং পিণ্ডখর্জুরং করুণং শ্রীফলং তথা।। (৭০/৫)

দেখা যাচ্ছে, খেজুর ও পিণ্ড-খর্জুর নামে দু’টি আলাদা খাবারের কথা রয়েছে শ্লোকদুটিতে। খেজুর তো নিঃসন্দেহে ফল। তাহলে পিণ্ডখর্জুর কোন খাবার? খেজুর পিষ্ট করে বানানো খাবার, নাকি খেজুর রস জ্বাল দিয়ে স্ফটিকাকৃতির খাবার সেটি ভাববার বিষয়। 

চৈতন্যচরিতামৃতেও পাই পিণ্ড-খর্জুরের কথা:

নারঙ্গ ছোলঙ্গ টাবা কমলা বীজপূর।
বাদাম ছোহরা দ্রাক্ষা পিণ্ড-খর্জুর।।
মনোহরা লাড়ু আদি শতেক প্রকার।
অমৃত গুটিকা আদি ক্ষীরসা অপার।।

শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন "বঙ্গ ভূমিকা" বইতে বলেছেন, বিশেষ জাতের আখের গুড়ের টুকরো মিছরির (বা পাটালির) মতো মিষ্টান্নের নাম ছিল 'খণ্ডশালুক' বা 'মৎস্যণ্ডী"। সে হিসেবে পিণ্ড-খর্জুর মানে খেজুর রস জ্বাল দিয়ে বানানো পাটালি গুড় অথবা খেজুর গুড় থেকে তৈরীকৃত মিষ্টান্ন বিশেষ বোঝায়। 
এখনো পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীতে খেজুর গুড় জ্বাল দিয়ে তাতে হালকা ভাজা বাদাম, কিসমিস, বেসনের বুন্দিয়া [অঞ্চলভেদে বুরিন্দাও বলে] মিশিয়ে তক্তি বানানো হয়। মেলা ও উৎসবে এ মিষ্টান্ন খাদ্যতালিকায় অপরিহার্য।    

কালীতন্ত্রম গ্রন্থের দ্বাদশ অধ্যায় 'ঔষধনিরূপণম্' এ বলা হয়েছে:

গাম্ভারী পৌষ্করং বীজং দ্রাক্ষা খর্জুরকং বলা।
নারিকেলেক্ষ্বাত্মগুপ্তা বিদারী চ পিয়ালকং।
মধুকং তালকুষ্মাণ্ডং মুখ্যোহয়ং মধুরো গণঃ।।

অর্থাৎ গাম্ভারী, পুষ্করবীজ, দ্রাক্ষা, খর্জ্জুর, বেড়েলা, নারিকেল, ইক্ষু, আলকুশীলতা, ভূমি কুষ্মাণ্ড, পিয়ালফল, যষ্টিমধু, তাল ও কুষ্মাণ্ড এই সমস্ত মধুরগণ নামে অভিহিত। 

আরো বলা হয়েছে, 

শ্বাসকাসাস্যমাধুর্য্যস্বরঘাতার্ব্বুদানি চ।
গলগণ্ডশ্লীপদানি গুড়লেপাদি কারয়েৎ।।

অর্থাৎ এ সমস্ত 'মধুরগণ' এর গুড় সেবন ও প্রলেপ করলে শ্বাসকষ্ট, কাশি, গলগণ্ড, স্বরভঙ্গ, শ্লীপদ প্রভৃতি রোগ উপশম হয়। দেখা যাচ্ছে, খেজুর গুড়ের প্রচলন কেবল খাবার হিসেবে নয়, ঔষধি হিসেবেও প্রচলিত ছিল অতি প্রাচীনকাল থেকে। 


খেজুর গুড়ের সন্দেশ

আবার মঙ্গলকাব্যগুলোতে আমরা অনেক পিঠাপুলির কথা পাই। এমন ধারণা করা ভুল হবে না যে, খেজুর গুড় দিয়ে অনেক পিঠা তৈরী হতো। উনিশ শতকের শেষের দিকে বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় প্রণীত রান্না বিষয়ক "পাক প্রণালী" নামক বইতে "খেজুর রসের অম্ল" ও "নলেন গুড়ের পায়েস" তৈরীর বিশদ বর্ণনা রয়েছে। টাটকা উৎকৃষ্ট মানের খেজুর রস জ্বাল দিয়ে তাতে কাঁচা তেঁতুল, আমড়া, চালতা প্রভৃতি টকফল মিশিয়ে নানা মশলা দিয়ে অত্যন্ত উপাদেয় চাটনি রান্না করতে বলা হয়েছে বইটিতে। আবার, বিপ্রদাস বলেছেন, খেজুর গুড়ের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট হলো নলেন গুড়। তাঁর বইতে নলেন গুড়ের পায়েস রান্নার বিস্তারিত প্রণালী বর্ণনা করেছেন। যুগযুগ ধরে নলেন গুড়ের পায়েস বাঙালির রসনা পরিতৃপ্ত করে আসছে।

সুতরাং আমাদের সাথে খেজুর গুড়ের সম্পর্ক নতুন কিছু নয়, শতবর্ষীও নয়, বরং সহস্রাব্দ প্রাচীন। 
বরেন্দ্রীর ধর্মাচরণেও খেজুর গাছ ও খেজুর মিশে আছে। জৈষ্ঠ্যমাসে জামাই ষষ্ঠী পূজার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো খেজুর। পুণ্ড্রের কালঞ্জরী শক্তিপীঠের অদূরে অবস্থিত ডহরপুর একটি বিখ্যাত তন্ত্রকেন্দ্র। এখানকার মন্দিরে পরস্পর আষ্টেপৃষ্টে দাঁড়িয়ে থাকা একটি শেওড়াগাছ ও খেজুরগাছ দেবী কালী হিসেবে পূজিত হন। খেজুরগাছ "ঢেলাই চণ্ডী" হিসেবে পূজিত হওয়ার কথা বর্ণনা করেছেন গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু তাঁর "বাংলার লৌকিক দেবতা" বইয়ে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর গ্রাম, নৈহাটির ঢেলাই চণ্ডী একটি খেজুরগাছ বলে উল্লেখ করেছেন। 


মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছেও খেজুর গাছ পবিত্র। রমজানে রোজা রেখে ইফতারের সময় খেজুর খাওয়ার বিধান রয়েছে। মৃতদের কবরে খেজুর ডাল পোঁতার রীতি রয়েছে। 
লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসে রক্ষিত উইলিয়াম টেইলরের আঁকা একটি চিত্রকর্মে শোভা পাচ্ছে খেজুর গাছে রস সংগ্রহের দৃশ্য, অঙ্কনসাল ১৮৪২। বরেন্দ্রীর নাটোর জেলার লক্ষ্মণহাটিতে বাংলার প্রথম চিনি তৈরীর যন্ত্রাংশের কারখানা স্থাপন করে স্কটল্যাণ্ডের ডব্লিউ বি রেনউইক কোম্পানি, সেই ১৮৮১ সালে। পরবর্তীতে কারখানাটি কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর তীরে স্থানান্তরিত হয়। ১৪১ বছরের প্রাচীন কোম্পানিটি আজো চলমান রয়েছে রেনউইক, যজ্ঞেশ্বর এণ্ড কোং নামে। 


পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীতে খেজুর গুড়ের সহজলভ্যতার কারণে এখানে অনেক রকম মিষ্টির প্রচলন আছে, যা গুড়ের তৈরী। গুড়ের জিলাপির পাশাপাশি আরো যেসব মিষ্টি প্রচলিত আছে গুড়ের রসগোল্লা, গুড়ের সন্দেশ ও গুড়ের মুরালি/গজা/খুরমা। আঞ্চলিক মেলাগুলো এ সমস্ত খাবার ছাড়া অপূর্ণ। গুড়ের তিলেখাজা বা তিলের গজা, গুড়ের বাতাসা ও ছাঁচের টুকরো অবশ্য প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। রসনা বিলাসী বাঙালি হিসেবে আর কোন খেজুর গুড়ের খাবার যেন হারিয়ে না যায় সে প্রত্যাশ্যা করি –

মলিন মুখে দিয়ে দেখ- নলিন খেজুর-গুড়-
বাহির-ভিতর হবে তাহার, মিষ্টিতে ভরপুর,
ওগো মিষ্টিতে ভরপুর।


তথ্যসূত্র:

১. ড. নীহাররঞ্জন রায়, ‘বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব),’ দেজ পাবলিসিং অষ্টম প্রকাশ:১৪২০ বঙ্গাব্দ
২. ‘সুশ্রুত সংহিতা,’ Uttarpara Jaykrishna Libraruy, Hooghly, PDF (year of Publication not found)
৩. সন্ধ্যাকর নন্দী, ‘রামচরিত,’ রাধাগোবিন্দ বসাক প্রণীত, জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স লিমিটেড, ১১৯৮ বঙ্গাব্দ
৪. শ্রীধর দাস, ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’, PDF (year of Publication not found)
৫. I-Tsing. Translated by J. Takakusu, ‘A Record of the Buddhist Religion as Practised in India and the Malay Archipelago,’ The Macmilian Company, Oxford, 1896
৬. প্রজ্ঞানন্দ স্থবির, ‘মহাবর্গ, ত্রিপিটক,’ ১ম খণ্ড , যোগেন্দ্র রুপসীবালা ত্রিপিটক ট্রাস্ট বোর্ড, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ
৭. পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, কালিকা পুরাণ (কালিকাপুরাণম্‌), নবভারত পাবলিশার্স, প্রথম নবভারত সংস্করণ, কার্ত্তিক, ১৩৮৪
৮. কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত, জগদীশ গুপ্ত প্রণীত, ভিক্টরিয়া প্রেস, জ্যৈষ্ঠ, ১২৬৯ বঙ্গাব্দ  
৯. সুকুমার সেন, ‘বঙ্গ ভূমিকা’, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, মে, ১৯৯৯
১০. কালীতন্ত্রম, শ্রীকালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্ন অনুদিত 
১১. পাক প্রণালী, বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায় 
১২. বগুড়ার ইতিকাহিনী, কাজী মোহাম্মদ মিছের

Comments

Popular posts from this blog

খোদার পাথর ভিটা, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)

গোবিন্দ ভিটা, মহাস্থানগড়

জিয়ৎ কূপ বা অমর কুণ্ড, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)