বরেন্দ্রীর গ্রামের কথা: কোকতারা
|| বরেন্দ্রীর গ্রামের কথা: কোকতারা ||
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীর পথে পথে স্নেহ ও মায়ার আঁচল বিছানো। প্রত্নস্থান খুঁজে বেড়ানোর সময় অগুনিত গ্রামের দেখা পেয়েছি আর মুগ্ধ হয়েছি। শান্ত-স্নিগ্ধ গ্রামগুলোতে নিস্তরঙ্গ জীবনপ্রবাহ। কোথাও ফসলের মাঠের ধারে, কোথাও গ্রাম্যহাটের পাশে, কোথাও বাঁশবন ও ঝোপঝাড়ের তলায়, কোথাও নিভৃত পথের পাশে দেখা মিলেছে প্রত্নস্থানের। আবার কোথাও হতাশ হয়েছি, পুরাতাত্ত্বিক স্থান বিলুপ্ত হতে দেখে। তবে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কখনো আমায় হতাশ করে নি, বরং আমার ক্লান্ত মনের ওপর প্রশান্তির পরশ বুলিয়েছে। অনাবিল আনন্দের পাশাপাশি অনেক প্রাচীন গ্রামের নাম আমাকে ভাবিয়েছে, স্থাননাম ধরে সুলুকসন্ধান করতে করতে পেয়েছি ইতিহাসের কত অভিনব সূত্র। ভাবছি মাঝে মাঝে এ রকম অভিজ্ঞতার কথা লিখবো এখানে। কয়েকদিন আগে বিক্রমপুরের ক্যাওটখালির কথা লিখলাম, অনেকেই বেশ পছন্দ করেছেন ছোট্ট লেখাটি। খুব উৎসাহ পেলাম এ থেকে। আজকে আরেকটি গ্রামের স্থাননাম ও ইতিহাস নিয়ে আলাপ করা যাক তাহলে।
পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীর একটি প্রাচীন জনপদ জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তঘেঁষা এই উপজেলাটি, ইতিহাসখ্যাত পাথরঘাটা প্রত্নস্থলসহ প্রায় অর্ধশত প্রত্নস্থান রয়েছে এখানে। প্রাচীন এ জনপদটির কেন্দ্রস্থল বা জিরো পয়েন্ট, পাঁচমাথা মোড় থেকে একটি রাস্তা উত্তরদিকে ছুটে চলেছে হিলি হয়ে দূরে–আরো দূরে, সেই দিনাজপুর, প্রাচীন কোটীবর্ষের পানে। আরেকটি সর্পিল রাস্তা পূর্বদিকে চলেছে সালাইপুর, সোনাকূল, শিরট্টী হয়ে ঘোড়াঘাটের দিকে। এ দু'টি রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বিস্তৃত মাঠ আর মাঝে মধ্যে গ্রামীণ হাট-বাজার পাবেন। আর বিস্তৃত মাঠের সীমানার ওপারে এক একটি গ্রাম৷ যেতে চান কোন গ্রামে? কোন অসুবিধা নেই, পিচঢালা বড় রাস্তা থেকে নেমে পড়ুন গ্রামের মেঠোপথে অথবা সরু পাকা রাস্তা ধরে আর কোথাও আলপথ বেয়ে। মেঠোপথগুলি চিরচেনা বরেন্দ্রীর লালমাটির পথ, হাতিশুঁড়-শ্বেতদ্রোণ-কন্টিকারি-কলমী, আর হেলায় গজিয়ে ওঠা দেশী খেজুরগাছ সে মেঠোপথের সাথী। সবখানেই পাবেন ছায়াঘেরা স্নিগ্ধ গ্রাম, বেশিরভাগের বুকে লুকানো আছে কত যুগের ইতিহাস।
পাঁচবিবি একটি অতি প্রাচীন জনপদ, তুলসীগঙ্গা-ছোট যমুনা-হারাবতী নদীবিধৌত এ জনপদের গ্রামগুলোতে পাবেন বিস্মৃতকালের ইতিহাসের সাক্ষ্য। এদিককার গ্রামের নামগুলোও যেন ইতিহাস ধারণ করে রেখেছে। পুণ্ড্রবর্ধনের অন্যতম প্রাচীন নগরী পাথরঘাটা তো রয়েছেই। আরো আছে মহীপালদেবের নাম আঁকড়ে রাখা মহীপুর, আছে অনেক প্রাচীন উঁচু ঢিবি বুকে নিয়ে উঁচাই গ্রাম, আরো পাবেন পীরপাল, বীরহার, কামদিয়া, শিরট্টী, সোনাকুল..আরো কত! পুণ্ড্রের বিখ্যাত পঞ্চনগরী আজকের পাথরঘাটা, অসংখ্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন ও প্রত্নস্থলের বিশাল ব্যাপ্তি এর সপক্ষে কথা বলে। প্রায় ৯ বর্গ কিলোমিটার জায়গাজুড়ে সে প্রাচীন নগরী গড়ে উঠেছিল তুলসীগঙ্গা নদীর দু'পাশ জুড়ে। নগরীর দুই অংশ জুড়ে দেয়া হয়েছিল নদীর উপর পাথরের সুদৃশ্য সেতু দিয়ে। সে সেতুর ভগ্নাবশেষ আপনি যতবার দেখবেন, চমৎকৃত হয়ে যাবেন। কি অসাধারণ কারুকার্য, কত উন্নত রুচিশীলতা।
পাথরঘাটায় গড়ে ওঠা মূল নগরীটি কেন্দ্রে রেখে পাঁচবিবির বিরাট অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য স্থাপত্য – ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং সেই সাথে জনবসতি। আমি পাঘরঘাটা থেকে অনেকটা দূরে শালাইপুরে প্রত্যন্ত গ্রামে দেখেছি বেশ বড় জায়গা জুড়ে প্রাচীন ঢিবি। মন্দির জ্ঞানে কতকটা রেখে বাকীটা কেটে ফেলেছে, সেখানেও পাওয়া যায় সুদৃশ্য ইট ও মৃৎপাত্রের অংশ। শিরট্টী বাজারের পাশে দেখেছি সুবিশাল ঢিবি, যার ওপরে কবরস্থান করা হয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। এগুলো সব ঘোড়াঘাটগামী রাস্তার পাশের অল্পক'টি গ্রামের কথা। বলতে থাকলে কত পর্ব যে হবে বলতে পারি না।
এখন চলুন হিলিগামী রাস্তা ধরে কিছুটা যাওয়া যাক। কিছুদূর এগিয়ে বাম পাশের সরু পথ ধরে গেলে আপনি চলে যাবেন মাউরীতলায়, অত্যন্ত প্রাচীন একটি কালীমন্দির। পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর টিনের ছাউনী দিয়ে এখনকার মন্দির। পুরনো ইটের ছড়াছড়ি, আদিমধ্যযুগের স্থাপত্যে ব্যবহৃত পাথরখণ্ড পর্যন্ত রয়েছে। নিভৃত গ্রামের প্রাচীন এ মন্দিরটির খ্যাতি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে এ স্থানটি বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ন।
আমাদের গন্তব্য অন্যদিকে, তাই আজকে এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। হিলি রোড ধরে আরেকটু এগিয়ে গেলে বামপাশে দেখা মিলবে ছোট যমুনা নদীর। নতুন করে খননের পর ছোট যমুনার পাড় হয়েছে বেশ উঁচু। নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আরো একটি কালী মন্দির, পুরাতন ও বেশ বিখ্যাত - দমদমা কালী মন্দির। সন্নিকটে পাঁচবিবি মহাশ্মশান। আর কিছুটা এগোলেই পাবেন একটি গ্রাম, আমাদের গন্তব্য, নাম কোকতারা। কাগজে-কলমে ৭টি প্রাচীন গুচ্ছ মন্দিরের অবস্থান এ গ্রামে। "কোকতারা" নামটি নিঃসন্দেহে বেশ প্রাচীন ও ঐতিহাসিক। নামটি নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
কোকতারা নামটির উৎস মাতৃকা উপাসনার সাথে সংশ্লিষ্ট বলে আমার মত, গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম থেকে এসেছে। এমন নামকরণ অনেক স্থানের ক্ষেত্রে পাওয়া যায়।
আমরা প্রথম কুমারগুপ্তের সময়কালের বৈগ্রাম তাম্রশাসন (৪৪৭ - ৪৮ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে জানতে পারি কোকামুখস্বামী বিষ্ণুর কথা, যার উদ্দেশ্যে ভূমিক্রয় ও দানের বিষয় তাম্রশাসনে উল্লেখ রয়েছে। কোকামুখ কথাটির অর্থ শৃগাল বা নেকড়ের মতো মুখাকৃতি। তন্ত্রে শিবা বা শৃগাল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হিসেবে পরিগণিত, দেবীর উগ্ররূপের সহচরী এরা। শৃগাল শ্মশানচারী ও শবভূক, শিবাধ্বনি অমঙ্গলসূচক। আবার শিবাধ্বনি রাত্রির প্রহর ঘোষণা করে। চণ্ডীতে শুম্ভ নিশুম্ভ বধের জন্য যখন ব্রহ্মাণী, ইন্দ্রাণী প্রভৃতি দেবীগণ আবির্ভূত হলেন; তখন কৌষিকীর দেহ থেকে আবির্ভূত হন দেবী চণ্ডিকা। তিনি শিবামুখী এবং শত শত শৃগালের রবের মতো অমঙ্গলসূচক ধ্বনি করেন। চণ্ডীতে পাই:
ততো দেবীশরীরাত্তু বিনিষ্ক্রান্তাতিভীষণা।
চণ্ডিকাশক্তিরত্যুগ্রা শিবাশতনিনাদিনী।। ২৩
ভাগবতপুরাণে শিবারূপী যোগমায়া বসুদেবকে গোকুলের পথ দেখিয়েছেন:
যমুনা ছাড়িল পথ বসুদেব যায়।
শৃগালরূপেতে মায়া সে পথ দেখায়।।
মহাভারতে অর্জুনের দুর্গাস্তবে দেবী দুর্গাকে "কোকামুখে" বলে স্তুতি করা হয়েছে:
মহিষাসৃক্প্রিয়ে নিত্যং কৌশিকি পীতবাসিনী।
অট্টহাসে কোকামুখে নমস্তেহস্ত রণপ্রিয়ে।।
বরেন্দ্রীর অসংখ্য জায়গায় শিবা পরিবৃতা কালিকা দেবী মূর্তি দেখেছি। এ সমস্ত জায়গায় শিবাভোগ অর্থাৎ শৃগালরূপে মাতৃকাকে ভোগ দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। রাঢ়ে শিবিখ্যা নামের লৌকিক দেবী রয়েছেন, যিনি কোকামুখী। বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে দুটি আবিষ্কৃত শিবা বা কোকামুখী দুর্গার মূর্তি পাওয়া গিয়েছে, যার একটি চট্টগ্রাম জাদুঘরে ও অন্যটি মহাস্থান জাদুঘরে রয়েছে।
কোকামুখী দুর্গা, চট্টগ্রাম জাদুঘরে রক্ষিত। ছবি: উইকিপিডিয়া
বৌদ্ধদেবী তারা পরবর্তীকালে তন্ত্র মতবাদে প্রবল প্রভাবশালী দেবী হিসেবে ঠাঁই নিয়েছেন। আবার দশ মহাবিদ্যার একজন হলেন তারা। কোকতারা গ্রামে কোকামুখী তারা দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠিত ছিল, সম্ভবত আদিমধ্যযুগ, মানে পাল আমলে। উক্ত কোকামুখী তারা নাম থেকে গ্রামের কোকতারা নামটি হয়ে যায়। বৌদ্ধ বজ্রযান ও তন্ত্রের চর্চাকেন্দ্র হিসেবে কোকতারা বিখ্যাত ছিল কিনা তার লিখিত দলিল না থাকলেও এখানে অবস্থিত সাতটি মন্দিরের অবস্থান থেকে বেশ ভালোভাবেই অনুমান করা যায়। পাথরঘাটার আশেপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বজ্রযান ও তন্ত্রের প্রবল উপস্থিতি নানা ধ্বংসাবশেষ, এখানকার হাল আমলের যাপিত জীবন, বিশ্বাস ও সংস্কার দেখে এবং নানা সময়ে আবিষ্কৃত প্রত্ননিদর্শন থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কোকতারা গ্রামে গত ত্রিশ বছর আগেও প্রচ্ছন্নভাবে তান্ত্রিক আচারের কথা জানা যায়। সুতরাং এ আলোচনা থেকে কোকতারা গ্রামের বিস্মৃত অতীতের একটি রূপরেখা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
১৯৮৬ সালের আর্কিওলজিকাল সার্ভে রিপোর্টে কোকতারা গ্রামের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। রিপোর্টের কিয়দংশ:
All the 7 temples in the group are now in various stages of ruins. The south-eastern one is surviving only upto its floor level. The biggest one is 9'9''×9'7'' with a height of 12 feet and the smallest one is 6'4'' square with a height of 11'. All these are similarly built and spanned by Bangla chouchala roofs, among which four are plainly plastered and two have parallel projection mouldings. Each of the temples is provided with only one arched doorway; four of them face south, one faces east and one faces west.
All these tiny structures are still in a fairly good state of prevention although partly covered by wild vegetation and creepers which have caused some minor fissures in the walls and the plasters in paches have peeled off.
দূর্ভাগ্যবশত বর্তমানে এ স্থাপনাগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। সময়ের করালগ্রাসে সবই বিলুপ্ত। কোকতারা গ্রামের ইতিহাসের উপাত্ত বা নিদর্শন লোপ পেয়ে গেলেও গ্রামের নামটিতে ইতিহাসের কথা লুক্কায়িত রয়েছে, সে আবহমান কাল থেকে। চলুন আমরা কোকতারা থেকে সামনে এগিয়ে যাই, আরেকটি গ্রামের পথে। ভালো থাকুক কোকতারা গ্রাম তার ইতিহাস বুকে নিয়ে।
তথ্যসূত্র:
Comments
Post a Comment