ছবির ইতিহাস, ইতিহাসের ছবি (৭৩ তম পর্ব)
|| বরেন্দ্রীর লোককথার আলোকে পুণ্ড্রে শাহ সুলতান (রঃ) এর আগমন ||
লোককথা আঞ্চলিক ইতিহাসের অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আপাতদৃষ্টিতে ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক মনে হলেও বেশিরভাগ লোককথার মাঝে ইতিহাসের অনেক ছিন্ন সূত্র লুকানো থাকে। এসব সূত্র খুঁজে জুড়ে দিতে পারলে আমরা জানতে পারি অতীতের অনেক অজানা কথা।
পুণ্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চলের অসংখ্য পুরনো লোককথা শুনেছি শৈশব থেকে। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমান সময়ে এসে বুঝি কত মূল্যবান লোককথা ছিল সেগুলো। আফসোস হয়, অনেক লোককথা ইতোমধ্যে হারিয়ে গিয়েছে এলাকার বয়োবৃদ্ধদের তিরোধানের সাথে।
আজকে এমনই একটি লোককথা নিয়ে আলাপ করা যাক। আমরা অনেকেই জানি, বাংলায় আগত প্রথম পীর শাহ সুলতান বলখি (রঃ), যাঁর হাত ধরে পুণ্ড্রে ইসলাম প্রচারের সূচনা। ইনি পুণ্ড্রের শেষ হিন্দু সামন্তরাজ পরশুরামকে পরাজিত করে পুণ্ড্র অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজা পরশুরামের সাথে শাহ সুলতান এর যুদ্ধ ইতিহাসে যেমন ঠাঁই পেয়েছে, তেমনি বরেন্দ্রীর লোককথায় আজো অমর হয়ে আছে। ঐতিহাসিকভাবে এ যুদ্ধের সময়কাল নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তবে আজকের আলোচ্য বিষয় এটি নয়। লোককথার আলোকে এ যুদ্ধের কথা যেভাবে পাওয়া যায় তা নিয়ে আজকের আলাপচারিতা। তবে আমরা যুদ্ধের আগের কথা বা প্রেক্ষাপট এখানে উল্লেখ করছি না, যেহেতু বিষয়টি বর্তমানের হিন্দু-মুসলিম টানাপোড়েনের দিক থেকে স্পর্শকাতর এবং অনেকে দ্বিতীয়বার না ভেবেই বিরূপ মন্তব্যের ঝড় তুলবেন। তাই কেবল যুদ্ধের সময়ের কথা বলছি।
মহাস্থানগড়ের জাহাজঘাটা
লোককথা অনুযায়ী, শাহ সুলতান বলখি (রঃ) পুণ্ড্রনগরে আসেন "মাহী সওয়ার" হয়ে, মানে মাছের পিঠে চড়ে। মাহী অর্থ মাছ। সে কারণে ইনি "শাহ সুলতান বলখী মাহীসওয়ার" নামে পরিচিত। বাস্তবিকভাবে মাছের পিঠে তো যাতায়াত করা যায় না। তাই এটুকু ধরে নেয়া যায়, ইনি মাছ আকৃতির নৌকায় চড়ে করতোয়া নদী বেয়ে পুণ্ড্রনগরে পৌঁছান। সে সময়ের বাংলায় নানা রকমের নৌকার কথা পাওয়া যায়। মৎস্যাকৃতির দ্রুতগামী নৌকা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
শাহ সুলতান (রঃ) যখন পুণ্ড্রনগরে আসেন, তিনি রাজা পরশুরামের দরবারে তাঁর নামাজ পড়ার জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা প্রার্থনা করেন। রাজা পরশুরাম প্রার্থনা মঞ্জুর করলে শাহ সুলতান (রঃ) সেই সাড়ে তিন হাত জায়গায় গোচর্ম বিছিয়ে নামাজ আদায় করতেন। তবে প্রতিদিন তিনি তাঁর গো-চর্ম টেনে বড় করতে থাকেন। এভাবে একদিন পরশুরামের সমস্ত রাজ্য ছেয়ে ফেলেন শাহ সুলতান (রঃ)। এর পরিণামে রাজা পরশুরামের সাথে তাঁর যুদ্ধ বাধে এবং পরশুরাম পরাজিত ও নিহত হন।
হাফিজুর রহমান (হরিহর পাল) এর সমাধি
এখানে লোককথার তথ্যগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। গোচর্ম টেনে লম্বা করে কি এত বড় করা যায় যে, রাজ্য ঢেকে ফেলা যাবে? রাজ্য ঢেকে ফেলার আগে পরশুরাম কি কিছুই জানতেই পারলেন না? বাস্তবতার পারদে লোককথা টেঁকে না।
মহারাজ শশাঙ্কের মেদিনীপুর তাম্রশাসন বিষয়ে পড়তে গিয়ে একটি বিষয়ে আমার চোখ আটকে যায়। শশাঙ্কের ঊনবিংশ রাজ্যাঙ্কে লিখিত তাম্রশাসনে গোচর্ম পরিমাপ ভূমিদানের উল্লেখ আছে।
......ভূমের্গোচর্ম্মমাত্রা [য়াঃ*] দানে স্বর্গঃ ফলং স্মৃতং (তম)।
গোচর্ম পরিমাপ ভূমি মানে ১৫০ হাত দীর্ঘ ও ১৫০ হাত প্রস্থ জমি বুঝায়, যেটি প্রায় সাড়ে তিন বিঘার সমান।
তাহলে রাজা পরশুরাম কর্তৃক সাড়ে তিনহাত জায়গা দেয়ার যে গল্প রয়েছে, সেটি কি তাহলে সাড়ে তিন বিঘা জমি? হিসেব তো তাই বলছে। গোচর্ম পরিমাণ ভূমিদানের বিষয়টি কালক্রমে সাড়ে তিন হাত জায়গায় গোচর্ম বিছিয়ে নামাজ পড়ার কথায় দাঁড়িয়েছে বলেই আমার ধারণা। রাজা পরশুরাম ভিনদেশী সন্তকে ভূমিদান করেছিলেন বসবাসের জন্য।
লোককথার আরেকটি অংশে আলোকপাত করা যাক – গোচর্ম টেনে বড় করে সারা রাজ্য ছেয়ে ফেলা। শাহ সুলতান (রঃ) এর স্মৃতিবিজরিত কয়েকটি জায়গা আছে পুণ্ড্রনগর থেকে কিছু দূরে। এ জায়গাগুলোতে ইনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন ও অবস্থান করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আমার মনে হয়, শাহ সুলতান (রঃ) পুণ্ড্রনগরে পৌঁছানোর আগে পুণ্ড্রের এ সমস্ত জায়গায় আস্তানা স্থাপন করে তাঁর সঙ্গীদের ইসলাম প্রচারের কাজে নিযুক্ত করেন। তারপর নিজে পুণ্ড্রনগরে পৌঁছে রাজা পরশুরামের দেয়া জায়গায় অবস্থান করতে থাকেন। তাঁর সংস্পর্শে এসে অনেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিতে থাকে।
এভাবে পুণ্ড্রনগর ও এর চারপাশে মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে যায়। এমনকি পুণ্ড্রনগরের প্রধান দ্বারপাল হরিহর পাল ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে শাহ সুলতান (রঃ) এর পক্ষাবলম্বন করেন। ফলে রাজা পরশুরামের সাথে যুদ্ধের সময় শাহ সুলতান (রঃ) এর বিরাট সৈন্যদল তৈরী ছিল। সংগঠিত সেনাদল ছাড়া রাজা পরশুরামকে সম্মুখ যুদ্ধে হারানো সম্ভবপর ছিল না। গোচর্ম-রূপ প্রভাবে পুণ্ড্রকে আচ্ছন্ন করে অবশেষে তা জয় করেন শাহ সুলতান (রঃ)।
শাহ সুলতান (রঃ) এর সফরসঙ্গীগণ পরবর্তীতে পীর হিসেবে বিখ্যাত হন, যাঁদের মাজার সমস্ত পুণ্ড্র-বরেন্দ্রী অঞ্চলজুড়ে অবস্থিত। অনেকগুলো মাজার আমি পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি। মাজারগুলোতে প্রাচীন স্থাপনার অসংখ্য ইট ও মৃৎপাত্রের টুকরো এবং পাথরখণ্ড দেখেছি। আমার ধারণা, জয়পুরহাটের পাথরঘাটার নিমাই পীর, কালাইয়ের হারুঞ্জার মাহ কামাল পীর মুকসিদ গাজী (রঃ) শাহ সুলতান বলখী (রঃ) এর সহযোগী ছিলেন। এঁদের মাজারও প্রাচীন পাল-সেন যুগের স্থাপনার ধ্বংসাবশেষের উপর স্থাপিত। এই মাজার থেকে সামান্য দূরে আরেকটি প্রাচীন স্থাপনা [একটি বৌদ্ধস্তুপ] ছোট ঢিবির আকারে দেখতে পাওয়া যায়। মাহ কামাল পীর মুকসিদ গাজী (রঃ) এর মাজারে গো-মাংসের শিরনী নিষিদ্ধ এবং গো-মাংস খেলে মাজারের ভেতরে ঢোকা নিষেধ। বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে।
লোককথার অন্য অংশ নিয়ে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা হবে, বিশেষত লোককথায় বর্ণিত গো-মাংসের ভূমিকা ও জিয়ন/জিয়ৎ কূপ নিয়ে।
তথ্যসূত্র:
১. নিজস্ব ক্ষেত্রসমীক্ষা
২. শিলালেখ-তাম্রশাসনাদির প্রসঙ্গ, ড. দীনেশচন্দ্র সরকার
%20%E0%A6%8F%E0%A6%B0%20%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0.jpg)

%20%E0%A6%8F%E0%A6%B0%20%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A6%BF.jpg)

%20%E0%A6%8F%E0%A6%B0%20%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B0.jpg)
Comments
Post a Comment