পাথরঘাটা: পঞ্চনগরীর সন্ধানে (১ম পর্ব)
পুন্ড্রবর্ধনের সন্নিকটেই জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলায় অবস্থিত পাথরঘাটার প্রত্নস্থল।
পুন্ড্রবর্ধনের বিকাশের সময়েই এই সুবিশাল ও উন্নত নগরীর পত্তন হয়। নগরীটি তুলসীগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠে। এই তুলসীগঙ্গা নদীটি দিয়ে করতোয়া নদী হয়ে পুন্ড্রনগরে যোগাযোগ ও পণ্য আদান প্রদান চলত।
![]() |
শীর্ণকায়া তুলসীগঙ্গা নদী। দুই পাড়ে মাটিচাপা প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। |
পুন্ড্রবর্ধনভুক্তির অন্তর্ভুক্ত কোটিবর্ষ ও পঞ্চনগরী নিয়ে আলোচনা ড: নীহাররঞ্জন রায়সহ অনেক পন্ডিত করেছেন। কোটিবর্ষের অবস্থান জানা গেলেও পঞ্চনগরীর আবিষ্কার এখনো নিঃসন্দেহভাবে করা যায়নি। প্রাচীন "দি পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি" বইতে পেন্টাপোলিস নামক নগরীর বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে। মূলত পেন্টাপোলিসকে (পঞ্চনগরী) একটি বিখ্যাত বন্দর ও ব্যবসায়িক নগরী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিবরণের ভিত্তিতে দিনাজপুর ও জয়পুরহাট জেলার সীমানায় এই সুবিশাল নগরীর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে অনেক পন্ডিত বর্তমান পাঁচবিবির পাথরঘাটা ও তৎসংলগ্ন প্রত্নএলাকার পক্ষেই মত দিয়েছেন। পাঁচবিবি নামটা যে পঞ্চনগরী থেকে আসা খুবই সম্ভব। আবার পাথরঘাটার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে তুলসীগঙ্গা নদী, যেটা কালের বিবর্তনে এখন শীর্ণকায়া। শীতের সময় নদীর পানি শুকিয়ে গেলে নদীর তলদেশে অসংখ্য পাথর দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবত কোন পাথর বোঝাই জাহাজ ডুবে গিয়েছিল এই স্থানে এবং এর থেকেই এই জায়গার নাম পাথরঘাটা হওয়া সম্ভব।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, পাথরঘাটায় গুপ্তযুগের তুলসীগঙ্গা নদীর উপর নির্মিত পাথরের সেতুর ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়েছে, যেটা বাংলাদেশের প্রাচীনতম পাথরের সেতু। এখানে ইতস্তত পড়ে আছে সেই ভগ্ন সেতুর পাথর। এই সেতুটি নিশ্চয়ই নগরীর দুটি অংশকে অথবা দুটি নগরকে যুক্ত করতেই নির্মাণ করা হয়েছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই এমনটা হওয়া সম্ভব।
![]() |
পাথরের সেতুর ভগ্নাবশেষ। যদিও বেশিরভাগ শিল্পকর্ম নষ্ট হয়ে গিয়েছে, যা বাকী আছে সেটাও খুব চমৎকার। |
প্রায় ৯ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন – অট্টালিকা, মন্দিরের ভগ্নাবশেষ ঢিবির আকারে, যেন উন্মুক্ত জাদুঘর।
এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: মিশন, উচাই, বহারামপুর, কাশিয়া বাড়ি, কুসুম্বা, গঙ্গারিয়া ও ব্রিধিগ্রামের একাধিক ঢিবি এবং নিমাই শাহের মাজার, বদের ধাপ, সাঁওতাল পাড়া।
বিভিন্ন সময় খননের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে তক্ষশীলায় প্রাপ্ত মৃৎপাত্রের অনুরূপ মৃৎপাত্রের অংশ, প্রাচীন ইটের টুকরা, পোড়ামাটির বস্তু, ধাতু ও পাথরের ভাষ্কর্যসহ আরও অনেক কিছু। এছাড়াও রয়েছে লৌহখন্ড, প্রাচীন মুদ্রা, কাঁচ খন্ড, পোড়ামাটির ফলক, প্রচুর গ্রানাইট পাথর, দরজার খিলান, চুড়ি ও নিত্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু জিনিসপত্র।
এখানে অবস্থিত খ্রীষ্টান মিশনারীর সীমানার ভিতরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢিবিগুলির একটি রয়েছে। নির্মাণকাজ পরিচালনার সময় একটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ ও প্রচুর প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গিয়েছে, যেগুলো মিশনারীর সংগ্রহে রয়েছে।
পাথরঘাটায় হিন্দু ও ইসলামের সহাবস্থানের একটি অনন্য নিদর্শন রয়েছে। একটি বড় ঢিপিতে রয়েছে কালী মন্দির ও নিমাই পীরের মাজার পাশাপাশি বহুবছর ধরে।
এই প্রত্নস্থানটি অনেকটা হুমকির মুখে। পুরো অঞ্চলটা চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য। বিভিন্ন ঢিপি খুঁড়ে প্রত্নবস্তু পাচার হচ্ছে অবাধে। অনেকে ইট বের করে এই ঢিপিগুলো থেকে। ফলে অনেক ঢিপি আবিষ্কারের আগেই হারিয়ে গেছে। কিছুকাল আগেও ট্রাক্টরের সাহায্যে অনেকগুলো ঢিপি সমান করে মিশনারির ঘর-বাড়ি, বাগান ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে। যতবার গিয়েছি নদীর ধার দিয়ে একটু হাঁটলেই চোখে পড়ে মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকা স্থাপনার ইট আর অজস্র পাথর। কিছু পাথর লোকজন ইচ্ছাকৃতভাবে ভাঙার চেষ্টা করে। হয়ত আর ১৫/২০ বছর পর পুরো প্রত্নস্থানটি হারিয়ে যাবে।
![]() |
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের সেতুর ভগ্নাবশেষ |
তথ্য সুত্র:
১. Bangladesh Archaeology 1979, Vol 1, No 1
২. প্রাচীন বাংলার ধুলো মাখা পথে, খন্দকার মাহমুদুল হাসান
স্থিরচিত্রের স্বত্ব: লেখক (মোঃ শাহরিয়ার কবির)। বিনা অনুমতিতে ব্যবহার নিষেধ।
পাথরঘাটা: পঞ্চনগরীর সন্ধানে (২য় পর্ব) পড়তে ক্লিক করুন এখানে
This comment has been removed by a blog administrator.
ReplyDelete